ইউপি নির্বাচনে নৌকার কেন এই বিপর্যয়?

দেশে দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত সারা দেশের চূড়ান্ত ফল জানা না গেলেও যেটুকু জানা গেছে তাতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সরকার দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক জায়গাতেই ‘নৌকা’ অন্যান্য অ-দলীয় বা নির্দলীয় প্রতীকের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন

দেশে দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত সারা দেশের চূড়ান্ত ফল জানা না গেলেও যেটুকু জানা গেছে তাতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সরকার দলীয় প্রতীক 'নৌকা' কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক জায়গাতেই 'নৌকা' অন্যান্য অ-দলীয় বা নির্দলীয় প্রতীকের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতেই নৌকা হেরে গেছে। নীলফামারী সদরেও একই অবস্থা, ১১টির মধ্যে ৯টিতে নৌকা হেরেছে। মাদারীপুরের কালকিনিতে ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ৩টিতে নৌকা জিতেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মজেলা গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে ৭টির মধ্যে ৬টিতেই নৌকা হেরে গেছে।

এই যখন অবস্থা, তখন একে স্থানীয় কোন্দল বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের কথা ভেবে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। অনেকেই অবশ্য বলার চেষ্টা করছেন যে, যারা জিতেছে তারাও তো নৌকারই লোক। কিন্তু এ যে অক্ষমের সান্ত্বনা—তা বলাই বাহুল্য। কারণ যারা জিতেছে তারা নৌকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই জিতেছে। তাদের মার্কা আর যাই হোক, নৌকা নয়। তাই তাদের 'নৌকার লোক' বলে চালিয়ে দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

মনে রাখা দরকার, সেই ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে যে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করেছিল, তখন থেকেই এ দেশের মানুষের কাছে 'আওয়ামী লীগ' ও 'নৌকা' এই দুটো শব্দ প্রায় সমার্থক হয়ে আছে। অবস্থাটা এমনই যে, গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত মনে করেন আওয়ামী লীগ মানেই নৌকা আর নৌকা মানেই আওয়ামী লীগ। তাই হয়তো আওয়ামী লীগ সমর্থকরা গর্ব করে বলে থাকেন 'আমি নৌকার লোক'। তাই যদি হবে, তাহলে নৌকার এমন বিপর্যয় কেন? এটা কি কেবলই সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের ফল, নাকি আরও অধিক কিছু? তাহলে কি সময়ের সঙ্গে নৌকার টানে ভাটা পড়েছে?

এ কথাতো সবাই জানেন যে, চলমান ইউপি নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিচ্ছে না। ছোট দুই-একটা দল অংশ নিলেও বাস্তবে এটা যে একদলীয় নির্বাচন তাতে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। তারপরেও নির্বাচনে কেন এত বিদ্রোহী প্রার্থী? আর নির্বাচন এলেই কেবল বিদ্রোহের ডঙ্কা বেজে উঠে কেন? অন্য সময় এটা কেন হয় না? ৫ বছর ধরে যে ব্যক্তিটিকে তুলসী গাছতুল্য করে তার পেছনে মিটিং-মিছিল করে জয়ধ্বনি দেওয়া হয়, হঠাৎ করেই সে বিছুটি পাতা হয়ে যায় কেমন করে?

এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত, আমাদের দেশে নির্বাচন হলো একটা উঁচু পর্যায়ের 'বিনিয়োগ'। হোক তা সংসদ নির্বাচন কিংবা হোক ইউপি নির্বাচন। সবাই বিশ্বাস করে একবার নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে পারলে ১০ দিক ঠেলে লক্ষ্মী এসে ঘরে ঢুকবে এবং ঢুকতেই থাকবে। আর এ জন্য কারও কাছেই কোনো জবাবদিহিতা করতে হবে না। প্রশাসন, পুলিশ, আইন, সব রাতারাতি এসে যাবে হাতের মুঠোয়।  খুন থেকে শুরু করে নদী দখল সবই হয়ে যাবে জলের মতো তরল। তাই একবার একটা রিস্ক নিলে কী এমন ক্ষতি?

দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চার জায়গাটা খুবই দুর্বল। সে কারণে দলের অভ্যন্তরে চেইন অব কমান্ড বলতেও কিছু নেই। ফলশ্রুতিতে প্রতিটা উপজেলাতেই রয়েছে একাধিক উপদল। এর সঙ্গে আছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ভবিষ্যৎ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে গত দেড় দশকে যে হারে দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে, তাতে দলের প্রতিটা কর্মীই বিশ্বাস করে কোনো রকমে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা কাঠামোতে একবার ঢুকে যেতে পারলে আর ঠেকায় কে? সে কারণে মোটামুটি একটু পরিচিতিসম্পন্ন সবাই যেভাবেই হোক শক্তি কাঠামোতে ঠাঁই করে নিতে চায়। এজন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ে, বাড়ে 'বিদ্রোহী'।

এতে করে নৌকার বিজয় সম্ভাবনা যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে নৌকার বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে, তা হলো গত দেড় দশক ধরে টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা হয়ে উঠেছে ভীতির, ভালোবাসার নয়। ভয় আর ক্ষমতার দর্প দেখিয়ে যে মানুষের মন জয় করা যায় না এ কথাটি দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ভুলেই গেছেন।

এ কারণে অনেক জায়গাতেই নৌকা হয়ে উঠেছিল একটা ভীতির প্রতীক। আর এই অবস্থাকে আরও পোক্ত করে তুলেছিল সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার হুমকি-ধামকি ও বক্তব্য-বিবৃতি। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছিল প্রতিপক্ষের প্রতি সরকারি দলের লোকজনের এই হুমকি-ধামকিও বেড়ে চলছিল। অবশ্য আমাদের এই দেশে নির্বাচনের সময় হুমকি-ধামকির সংস্কৃতি নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ধরনের ভাষা আর ইঙ্গিত ব্যবহার করা হচ্ছিল তা অতীতে কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ে না। নির্বাচনের কয়েক দিন আগে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় একজন প্রার্থী এই মর্মে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, নৌকায় ভোট না দিলে কবরস্থানেও জায়গা দেয়া হবে না। শরিয়তপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান নৌকার বিপক্ষে ভোট চাইলেই অবরুদ্ধ করে রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব অবশ্য একটু ভদ্র ভাষায় বলেছিলে যে, নৌকায় ভোট না দিলে কেন্দ্রে আসার দরকার নেই।

তবে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে সরকার দলীয় নেতার হুমকিটাই মনে হয় স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ হুমকি। তিনি বলেছিলেন, দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে প্রয়োজনে এ-কে ৪৭ ব্যবহার করা হবে। এই সব হুমকির খবর প্রতিটা জাতীয় দৈনিকেই এসেছে। তারপরও নির্বাচন কমিশন বা সরকারের প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু করেনি। হয়তো তারা শেষ মুহূর্তের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন।

কিন্তু এই জাতীয় হুমকি-ধামকি যে আধুনিক সভ্য সমাজে অচল, এ কথাটা অনেকেই বুঝতে পারেননি। আর এসবের মধ্য দিয়ে যে নৌকা ছিল স্বাধীনতার প্রতীক, তাকেই নৌকার মাঝিমাল্লারা বানিয়ে দিলো ত্রাসের প্রতীক। আর সাধারণ ভোটাররা তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো ব্যালটে।

অন্যদিকে অনেক প্রার্থীই ভেবেছিলেন ২০১৮ সালে যেভাবে প্রশাসনের লোকেরা ব্যালটে সিল মেরে দিয়েছিল, এবারেও হয়তো তাই হবে। সে কারণে তারা ভোটারদের বেশি গুরুত্ব না দিয়ে প্রশাসন আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই বেশি তাকিয়ে থেকেছেন। তারা এটুকু বুঝতে পারেননি যে, এর নাম আমলাতন্ত্র। উপরের নির্দেশ আর ঝোপ বুঝে কোপ দেওয়াই তাদের কাজ। তাই ২০১৮ সালে যা ঘটেছে, ২০২১ সালেও তাই ঘটবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। দক্ষ মাঝি জোয়ার-ভাটার কথা মাথায় রেখেই নৌকা চালান। কিন্তু আমাদের মাঝিরা শুধু জোয়ারের কথাই ভেবেছে, ভাটার কথা মনে রাখেননি। তাইতো আজ নৌকার এমন বিপর্যয়।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা, পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, আফগানিস্তান

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Goods worth Tk 16k imported at Tk 2.63 crore

State-run Power Grid Company of Bangladesh Ltd (PGCBL) imported 68 kilograms of tower bolts, nuts and washers from India for a whopping $2,39,695 or Tk 2.63 crore, which is 1,619 times the contract value.

10h ago