মুক্তিযুদ্ধ

১৭ নভেম্বর ১৯৭১: ‘সমাধানের জন্য শেখ মুজিবের মুক্তি বাধ্যতামূলক’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৭ নভেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত রেহমান সোবহানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, 'এক মাস আগে পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুর কারাগারে আদালতে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখা গেছে। তার শারীরিক অবস্থা এখন সংকটজনক হলেও তাকে উন্নত ও উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে না। শেখ মুজিবুর রহমানকে যেভাবে রাখা হয়েছেও তা আদতে নিষ্ঠুর। পাকিস্তান সরকারের উচিৎ তার শারীরিক দিক ও রাজনৈতিক দিক বিবেচনা করে তাকে মুক্তি দেয়া। পাকিস্তান যদি সত্যিই কোনো সমাধান চায় তবে শেখ মুজিবের মুক্তি বাধ্যতামূলক। কারণ তার মুক্তি ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কখনোই আলোচনার টেবিলে উপস্থিত হবে না। একই সঙ্গে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য ইন্দিরা গান্ধী পুরো বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তান ও দীর্ঘসময় তাকে বন্দী করে রাখতে পারবে না।

অন্যদিকে রেহমান সোবহান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, 'মার্কিন সরকারের উচিৎ আচরণ সংযত করা। কারণ তারা পাকিস্তানের সাথে একজোট হয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তান সরকার বারবার মিথ্যা দাবি তুলে বলছে আমাদের নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের আলোচনা হয়েছে যা পুরোটাই বানোয়াট। আমরা আগেও বলেছি আমাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কেবল শেখ মুজিবুর রহমান। তার মুক্তির পর আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হবে কিনা সে সিদ্ধান্তে উপনীত হবো। তাকে ছাড়া কোনো ধরনের আলোচনার সম্ভাবনা নেই।

ঢাকায় এদিন

১৭ নভেম্বর পাকিস্তানি সামরিক সরকার রাত সাড়ে ৮টা থেকে ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে। এদিন রাতে কারফিউর সময় হানাদার বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে বিভিন্ন জায়গায় ৪ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। এছাড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাতে বিভিন্ন গলি ও বাসাতে তল্লাশি করে কয়েকশ তরুণকে আটক করে।

ভারতে এদিন

১৭ নভেম্বর ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পশ্চিম জার্মানি সরকারের পাঠানো দুই হাজার টন খাবার ও কাপড়চোপড় এবং ওষুধ রেডক্রস ও ইউনিসেফের মাধ্যমে কলকাতায় এসে পৌঁছায়।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৭ নভেম্বর লন্ডনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন 'সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালেক ডগলাস হোম। মূলত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্রিটেন সফর শেষেই চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল।

১৭ নভেম্বর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি মাহমুদ আলী জাতিসংঘে চীনের অন্তর্ভুক্তিতে চীনা প্রতিনিধিদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, 'জাতিসংঘের যেসব লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি, চীনের অন্তর্ভুক্তির ফলে সেসব লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা জোরদার হবে।'

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

ছাব্বিশা গণহত্যা

১৭ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের ছাব্বিশা গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন ৩২ জন নিরীহ গ্রামবাসী।

এদিন সকালবেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল রাজাকারদের সহযোগিতায় ছাব্বিশা গ্রামের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। প্রথমে হানাদার সেনা স্থানীয় বিশু মণ্ডলের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট চালাতে গেলে বিশু মণ্ডল সৈন্যদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পিটিয়ে পার্শ্ববর্তী পুকুরে নামানোর সময় হানাদার বাহিনীর চোখে পরে যায়। এসময় তারা তাঁকে ব্রাশফায়ার করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে জীবন্ত অবস্থায় গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর বিশু মণ্ডলের বাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকদের ধরে নিয়ে এসে গণহত্যা চালায়। হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মাত্র ১৭ দিন বয়সী শিশুও। তাকেও আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে হত্যা করে হানাদারেরা।

১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের মিরসরাইতে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আসার খবর পেয়ে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে। পরে ওই পথ দিয়ে হানাদার বাহিনীর একটি দল যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ গড়ে তোলেন। এসময় হানাদার বাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এসময় দুইপক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসই সংঘর্ষে ৩ জন হানাদার সেনা আহত হয়। অন্যদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

১৭ নভেম্বর রাজশাহীর গেরিলারা মিরারপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের উপর মর্টার আক্রমণ চালায়। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য আহত হয়।

১৭ নভেম্বর লক্ষ্মীপুরে সুবেদার ওয়ালীউল্লার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মধ্যরাতে রামগঞ্জেঢ় রাজাকারদের ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেয়। এসময় বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক পাকিস্তান ১৭ ও ১৮ নভেম্বর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৮ নভেম্বর ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর ১৮ নভেম্বর ১৯৭১

নিউইয়র্ক টাইমস ১৭ নভেম্বর ১৯৭১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
US attack on Iran nuclear sites

Iran denounces US attack as ‘outrageous’

Iran says 'no signs of contamination' after US attacks on key nuclear sites

10h ago