লাখ টাকার ‘যোদ্ধা’ মোরগ

ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন ঠাণ্ডা হাওয়া আর ঘাসের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। এই উত্তুরে হাওয়ায় এখন পর্যন্ত আমলকীর ডালে 'নাচন' লেগেছে কি না জানা যায়নি। তবে, ঠিকই নাচন লেগেছে জনপ্রিয় লোকজ উৎসব মোরগ লড়াইয়ের সংগঠকদের মনে।

ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন ঠাণ্ডা হাওয়া আর ঘাসের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। এই উত্তুরে হাওয়ায় এখন পর্যন্ত আমলকীর ডালে 'নাচন' লেগেছে কি না জানা যায়নি। তবে, ঠিকই নাচন লেগেছে জনপ্রিয় লোকজ উৎসব মোরগ লড়াইয়ের সংগঠকদের মনে।

মোরগ লড়াই এখনো দেশের নানা প্রান্তে প্রচলিত জনপ্রিয় এক খেলা। সাধারণত এই লড়াইয়ের মৌসুম ডিসেম্বরে শুরু হয়ে চলে জুন-জুলাই পর্যন্ত।

লড়াইয়ের প্রস্তুতি। ছবি: স্টার

বিজয়ের মাসে যুদ্ধের মাঠে নামাতে চলছে 'যোদ্ধা' মোরগের প্রশিক্ষণ। এতে আছে সুইমিং (লেজ ধরে রেখে পানি ভর্তি চৌবাচ্চার ভেতর সাঁতার), রানিং (উন্মুক্ত জায়গায় দৌড়) ও টাপা ঘুরানো (দমের পরীক্ষা)।

ঢাকার মগবাজারের তালতলা গলির বাসিন্দা ইমতিয়াজ উদ্দীন তার বাড়ির ছাদে এমন ৪টি মোরগের সঙ্গে ২টি মুরগিও পুষছেন। এগুলো 'আসলি' বা যোদ্ধা মোরগ।

পেশায় ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ উদ্দীন ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশ আসিল মোরগ উন্নয়ন সংস্থার কোষাধ্যক্ষ। উৎসবসহ নানান লোকজ ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে অনেকে মোরগ লড়াই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত সেসব প্রতিযোগিতায় নিজের মোরগ নিয়ে ছুটে যান ইমতিয়াজ উদ্দীন।

গত মঙ্গলবার ইমতিয়াজ উদ্দীনের ৪তলা বাড়ির ছাদে উঠে দেখা যায়, সুপরিসর খাঁচা ও বড় ফোঁকরযুক্ত কাঠের বাক্সে আটকে রাখা মোরগগুলো প্রায় পালকহীন, নগ্ন বুক। মাংসল ও পেশিবহুল পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মোরগগুলো যেন চৌকশ কোনো দৌড়বিদের ভাস্কর্য।

ছবি: স্টার

ইমতিয়াজ উদ্দীন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, লড়াইয়ের জন্য মোরগ পালন তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। একসময় তার দাদা এই মোরগ পুষেছেন, বাবা-চাচারও শখ ছিল মোরগ লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার। এখন তিনি পালন করেন।

কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, মগবাজার এলাকার দিলু রোডের নামকরণ হয়েছে যে দিলু ব্যাপারীর নামে, তার ছেলেদেরও ছিল এই মোরগ পালনের শখ। ইমতিয়াজ উদ্দীনের দাদা শামসুদ্দিন ব্যাপারী ছিলেন দিলু ব্যাপারীর বড় নাতি।

ইমতিয়াজ উদ্দীনের সংগ্রহে থাকা মোরগ-মুরগিগুলোর মধ্যে ৩টি ভারত থেকে আনা হয়েছে। বাকিগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থেকে সংগ্রহ করা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মোরগটি কিনতে হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকায়। আর মুরগিগুলো কেনা হয়েছে বাচ্চা দেওয়ার জন্য।

ইমতিয়াজ বলেন, 'লড়াইয়ের উপযোগী পূর্ণবয়স্ক একটা মোরগের দাম নির্ধারিত হয় জাত ও লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার ওপর। এ ক্ষেত্রে মোরগটি কতগুলো লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে, কতগুলো লড়াই জিতেছে—এসব বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর নিরিখে পূর্ণবয়স্ক একটি মোরগের দাম লাখ টাকাও উঠতে পারে। যোদ্ধা মোরগের বিভিন্ন জাতের মধ্যে আছে জাওয়া আসলি, লাকা আসলি, কালো আসলি ইত্যাদি।'

কথিত আছে, মোগল আমলে সরাইলের এক দেওয়ান সুদূর ইরান থেকে এক ধরনের যুদ্ধবাজ মোরগ এ দেশে নিয়ে আসেন। যা পরবর্তীতে আসলি মোরগ নামে পরিচিতি পায়। সে সময় দেওয়ানদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এই অঞ্চলে মোরগ লড়াইয়ের গোড়াপত্তন ঘটে। যা পরে দেশের অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

ছবি: স্টার

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার 'ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী' বইয়ে বলেছেন, ঢাকার আদি এই প্রতিযোগিতা মোগল আমলের শেষ দিকে অব্যাহত ছিল। ধনাঢ্যরা ছিলেন মোরগ লড়াইয়ের পৃষ্ঠপোষক। তাই একে শাহি শখ বলা হতো। ধনীদের এই আয়োজনে অংশ নিত ভিনদেশি জাতের মোরগ। আর দেশি মোরগের লড়াই ছিল সাধারণের আয়োজন।

ইমতিয়াজ জানান, বিজয় দিবস উপলক্ষে আগামী ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার বছিলায় একটি 'ফ্রেন্ডশিপ' লড়াইয়ের আয়োজন করেছে তার সংগঠন। এটাকে সামনে রেখে তিনি তার পোষা মোরগগুলোকে তৈরি করতে শুরু করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৪০টির মতো ক্লাব আছে, যারা এ ধরনের লড়াইয়ের আয়োজন করে। প্রতিযোগিতার অন্তত এক মাস আগে ক্লাবগুলো একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পারস্পরিক আলোচনা ও সম্মতির ভিত্তিতে স্থান নির্ধারিত হয়।

ইমতিয়াজ জানান, একটা মোরগ কমপক্ষে ২ ঘণ্টা লড়াই করতে পারে। আর চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ের নির্ধারিত সময় ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিট।

তালতলা গলিতে তার বাড়ির ছাদে বড় ৩টি মোরগ রাখা ছিল উন্মুক্ত জায়গায়, আলাদা আলাদা খাঁচায়। আর ২টি মুরগিসহ বাকি আরেকটি মোরগ ছিল ছাদের ওপর তৈরি আলাদা ঘরে, বাক্সের ভেতর। সেখানে দেখা গেল ১টি মুরগি ২টি ডিম পেড়ে রেখেছে।

ছবি: স্টার

ইমতিয়াজ জানান, এর প্রতিটি ডিমের দাম অন্তত ৫০০ টাকা। আর জাতভেদে প্রতি বাচ্চা ১৫ হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়।

মোরগকে উপজীব্য করে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা 'ইঁদু মিয়ার মোরগ' বাংলা সাহিত্যে পরিচিত সরস গল্পগুলির একটি। পোষা মোরগের প্রতি দুর্বলতা দেখে লোকে যেটাকে ইঁদু মিয়ার 'ধর্মব্যাটা' বলে ঠাট্টা করত।

আবার ১৯৫৭ সালে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এস্পানিয়োল ভাষায় লেখেন উপন্যাস 'এল কোরোনেল নো তিয়েনে কিয়েন লে এস্ক্রিবা'। ইংরেজিতে যেটা 'নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল' নামে প্রকাশিত হয়েছে।

ওই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ কর্নেল দম্পতির অভাব-অনটনের সংসারে ছিল উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলে আগুস্তিন। কলম্বিয়ার ঐতিহ্যবাহী মোরগ-লড়াইয়ের সময় তাকে হত্যা করা হয়। ছেলের স্মৃতিস্বরূপ মোরগটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান কর্নেল। এক পর্যায়ে মোরগের খাবার আর নিজেদের খরচের জন্য ছেলের রেখে যাওয়া সেলাই মেশিন বিক্রি করে দেন তিনি। আবার খিদের তাড়নায় মোরগের জন্য কয়েকজন ছেলের দেওয়া খাবারের অংশও তারা গোপনে খেয়ে নেন।

পোষা মোরগের প্রতি মমত্ববোধের এই বিষয়টি টের পাওয়া গেল ইমতিয়াজের কথাতেও। তিনি বলেন, 'মোরগগুলো আসলে পরিবারের সদস্যদের মতোই। আর সাধারণ সময়ের বাইরে একেকটি লড়াইয়ের পর অনেক দিন ধরে মোরগগুলোকে খুব যত্নে রাখতে হয়। যেমন গরম সেঁক দেওয়া, মালিশ করা, ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ানো ইত্যাদি। খাবারের দিকেও দিতে হয় বিশেষ নজর।'

Comments

The Daily Star  | English

Where should I invest my money?

Amid persistently higher inflation in Bangladesh for more than a year, the low- and middle-income groups are struggling to meet their daily expenses.

13h ago