‘এতদিন পর এসব কথা বলা খুব কষ্টের’

মনোয়ারা বেগম সঠিকভাবে তার জন্ম তারিখ বলতে পারেন না। তবে তার বেশ মনে আছে ১৯৭১ সালে তিনি সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।
টর্চার সেলের সামনে মনোয়ারা বেগম। ছবি: টিটু দাস

মনোয়ারা বেগম সঠিকভাবে তার জন্ম তারিখ বলতে পারেন না। তবে তার বেশ মনে আছে ১৯৭১ সালে তিনি সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।

নিজের জীবনের চরম নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে মনোয়ারা বলেন, 'আমার জন্ম বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের বাদলা গ্রামে। আমি তখন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। হঠাৎ শুনলাম পাকিস্তানি মিলিটারি যেকোনো দিন আসবে।'

'সেদিন তারিখ কত ছিল তা মনে নেই। তবে বর্ষা শুরু হয়েছে তা বেশ মনে আছে। আমার নানি ময়জান বিবি বললেন, পাকিস্তানিরা নদী পার হয়ে আসতে পারবে না। সিদ্ধান্ত হলো—আমরা কীর্তনখোলা নদীর পারে চরকাউয়ায় নানা বাড়ি যাব। নানি ও আমি নৌকায় উঠি সেখানে যাওয়ার জন্যে।'

'কীর্তনখোলা পার হয়ে দেখি মিলিটারিরা গ্রামে আগুন দিচ্ছে। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। নানা বাড়িতে আগুন দেখে নানি আমাকে পালিয়ে যেতে বললেন। আমি একটা বড় গাছের পেছনে লুকালাম। পাকিস্তানি আর্মিরা ১০-১২ জনকে বেঁধে খালের পাশে নিয়ে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার করল। অনেকের মাথার মগজ ছিটকে গেল।'

'আমি সহ্য করতে না পেরে গাছের গোড়ায় শুয়ে পরলাম। হঠাৎ এক মিলিটারির নজরে পড়ে গেলাম। তারা আমাকে চুলের মুঠি টেনে গানবোটে উঠাল। সেখানে গিয়ে দেখি আরও কয়েকজন মেয়ে। তাদের পরিচয় আমার জানা ছিল না। আমাদেরকে নিয়ে মেডিকেল কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কোয়ার্টারে নিয়ে আসল।'

'এরপর যেন আমাদের জীবনে নরক নেমে আসে। দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আকাশ দেখতে পারিনি। প্রতিদিন রাতে আমাদের নিয়ে যেত ওয়াপদা এলাকায় যেখানে পাকিস্তানি আার্মিরা থাকতো। সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের অত্যাচার করতো। এমনকি চার-পাঁচ জনও অত্যাচার করতো। যে সময় আমাদের ছেড়ে দিত তখন আমাদের জ্ঞান থাকতো না। আমি কয়েকদিন পর অসুস্থ হলেও ওদের হাত থেকে রেহাই পাইনি। আমাদের ঠিক মতো খাবার দিত না। মাঝে-মধ্যে খাবার ছুড়ে দিত।'

তিনি আরও বলেন, '৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত হওয়ার ৩ দিন আগে আমাদের ওয়াপদা পাকিস্তানি আর্মির এলাকায় নিয়ে আসা হয়। রাত হলেই গুলির শব্দ, আর নারী-পুরুষের ভয়ানক চিৎকার। আমি ওয়াপদা টর্চার সেলে আরও অন্তত ৭-৮ জন নারীকে দেখেছি। কেউ যেন আত্মহত্যা না করতে পারে সেজন্য শাড়ি বা ওড়না পরতে দিত না। এখানে গুলির শব্দে মনে হয়েছে প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ জনকে হত্যা করা হতো।'

'টর্চার সেলে আমাদের ওপর অনেক নির্যাতন করা হতো। একদিন এক নারীকে মিলিটারিরা জিজ্ঞেস করল "মুক্তি কাঁহা"? মেয়েটি কিছু বলতে পারল না। এক মিলিটারি তার শরীরের ওপর উঠে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করলো। এক সময়ে মেয়েটার রক্তে টর্চার সেল ভেসে গেল। সেখানেই সে মারা গেলে তাকে খালে ফেলে দেওয়া হলো।'

'এভাবেই ওরা গভীর রাতে একেক জনকে মেরে ফেলতে লাগল। আমরা মৃত্যুর আশঙ্কা করতে লাগলাম। মৃত্যুর বদলে পেয়েছি অপ্রত্যাশিত মুক্তি! একদিন দেখি সব মিলিটারি উধাও। বাইরে হট্টগোল। কে যেন টর্চার সেল খুলে দিল। আমরা বেরিয়ে এলাম। মুক্তির স্বাদ নেওয়ার আগেই মাঠে জ্ঞান হারালাম। পরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে আমাদের চিকিৎসা হলো। বিশেষ করে, আমার যৌনাঙ্গে অপারেশন লাগল।'

'সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলেও সেখানে আমার ঠাঁই হলো না। মা আমাকে নিতে চাইলেও বাবা ফিরিয়ে দিল। সেসময় একজন পথচারী তার বাড়িতে থাকার কথা বলে আমাকে বাগেরহাটে বিক্রি করে দেয়। সেখানে বছর খানেক পর আরেকজন, খুলনার ফুলতলা ও সবশেষে আরেকজনের হাত ঘুরে ফরিদপুরের যৌনপল্লিতে ঠাঁই হলো। সেখানে এক পুলিশের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। সেই ঘরে আমার এক মেয়ে হয়।'

মনোয়ারা বেগম এই প্রতিবেদককে তার ওপর নারকীয় অত্যাচারের স্থান ওয়াপদা কোয়ার্টার ঘুরিয়ে দেখান। নিজ জীবনের অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির আবেদন করেন। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বললেন, 'আজ এতদিন পর এসব কথা বলা আমার জন্যে খুব কষ্টের। সরকার যদি আমাদের কষ্ট বোঝে তাহলে কিছুটা শান্তি পাবো।'

বরিশাল নগরীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মহিউদ্দিন মানিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই বীরাঙ্গনার ওপর যে ভয়াবহ অত্যাচার হয়েছে তা কল্পনাও করা যায় না। আমরা তার আবেদন দ্রুত মঞ্জুরের আশা করছি।'

Comments

The Daily Star  | English

History of student protests in the USA

American campuses -- home to some of the best and most prestigious universities in the world where numerous world leaders in politics and academia have spent their early years -- have a potent history of student movements that lead to drastic change

1h ago