মুক্তিযুদ্ধ

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ভারত ও ভুটান

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৬ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রথম দেশ হিসেবে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। লোকসভার অধিবেশনে এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা করেন। এসময় লোকসভার সদস্যরা দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষণাকে স্বাগত জানান। একইসঙ্গে লোকসভার অধিবেশনে হর্ষধ্বনির সঙ্গে 'জয় বাংলা' স্লোগান উচ্চারিত হয়। এদিন ইন্দিরা গান্ধী অধিবেশনে তার বক্তব্যে বলেন, 'বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি স্বৈরতান্ত্রিক ও গণহত্যা নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো।' 

তিনি বলেন, বাংলাদেশের নতুন সরকার 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার' হিসেবে অভিহিত হবে। আমি বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও তাদের অন্যান্য সহকর্মীদের কাছে আমাদের ঐকান্তিক সংবর্ধনা ও আন্তরিক অভিবাদন পৌঁছে দিই।' ইন্দিরা গান্ধী আশা প্রকাশ করে বলেন, 'সময়ে আরও অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং শিগগির জাতিসংঘে বাংলাদেশ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবে।'

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভারতের সিদ্ধান্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানানো হয়। এর আগের দিন ৫ ডিসেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নিজেদের কর্মনীতি সম্পর্কে একটি বিবৃতি দিলে ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি চূড়ান্ত করে।

এদিন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক তারবার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার তারবার্তায় বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ও বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিবাদন জানাচ্ছে। তার এই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত আমাদের বিজয়ের পথে অনেকখানি পথ ধাবিত করলো।' ভারত সরকার বাংলাদেশের ন্যায় সঙ্গত মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন করায় ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বন্ধুত্ব শান্তি ও সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো।'

এদিন ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দানের কয়েক ঘণ্টা পরেই কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন৷ এরপর তিনি তার বক্তব্যে বলেন, 'বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর বীর সৈনিকেরা যেভাবে এগিয়ে এসে বাংলাদেশকে বিজয়ের দিকে অগ্রসর করেছেন তা অতুলনীয়৷ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে তাদের ত্যাগ ও রক্তের ফলে যে বন্ধন গড়ে উঠেছে তা চিরকাল অটুট থাকবে।' 

পাকিস্তানে এদিন

৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়ার ৫ ঘণ্টা পরে পাকিস্তান সরকার ভারতের সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এক ঘোষণায় পাকিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের স্বীকৃতির কারণে আমরা ভারতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করছি। ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের চরম বিদ্বেষ ও পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের সনদের নীতি বিরুদ্ধ। জাতিসংঘে শিগগির পাকিস্তান এই বিষয়টি উত্থাপন করবে।' 

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৬ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই ভুটান তারবার্তার মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ৮টি দেশের পক্ষে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে ফের উত্থাপিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বারের মতো তাতে ভেটো দেয়।

৬ ডিসেম্বর মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুজনেৎসেভের সঙ্গে বৈঠক করেন মস্কোতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ড. কে এস শেলভানকর। এসময় দুজনের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা ব্যাপী বৈঠকে ভারতের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও পাক ভারত সমস্যায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের বিতর্ক নিয়েও পর্যালোচনা করা হয়।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৬ ডিসেম্বর ফেনী, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট হানাদার মুক্ত হয়। 

৬ ডিসেম্বর যশোরে থাকা পাকিস্তানী নবম ডিভিশনের সৈন্যরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে মাগুরার দিকে পালিয়ে গেলে হানাদার মুক্ত হয় যশোর। এর আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যশোরের চৌগাছা ও ঝিকরগাছা এলাকার মধ্যবর্তী কাবিলপুর গোয়ালহাটি এলাকা দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। 

৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় মেহেরপুর শহর। এর আগের দিন ভারতের তেহট্ট ক্যাম্প থেকে মেহেরপুর অপারেশনের জন্য ৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা মুজিবনগরের দারিয়াপুর হয়ে কোলা গ্রামে পৌঁছায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের অবিরাম গুলি বর্ষণের পালটা গুলি চালাতে থাকে হানাদার বাহিনী। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ আক্রমণে পালায় পাক হানাদার বাহিনী। বেশ কয়েকজন রাজাকার ও হানাদার সেনা এসময় আহত হয়। ৬ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা 'জয় বাংলা' স্লোগানে মেহেরপুর শহরে প্রবেশ করেন।

৬ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজি রাতে এক নির্দেশে ঝিনাইদহ অবস্থান থেকে সরে এসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ঢাকা রক্ষার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী তিনি ঢাকার পথে পেছনে এসে মেঘনার তীরে সৈন্য সমাবেশ করার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু তা আর তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ ততক্ষণে ঢাকা-যশোর সড়ক মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এদিকে ঝিনাইদহ ছেড়ে যাওয়ায় ঝিনাইদহ ও হানাদার মুক্ত হয়।

৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সুনামগঞ্জের দক্ষিণের সড়ক ও হাওর পথে পালিয়ে যায়। এতে মুক্ত হয় সুনামগঞ্জ।

৬ ডিসেম্বর ছাতক শহর হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী সিলেটের বিশ্বনাথের লামাকাজী এলাকায় চলে যায়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র 

দৈনিক যুগান্তর ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ 

দৈনিক পাকিস্তান, ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ 

টাইমস অব ইন্ডিয়া ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ 

আনন্দবাজার পত্রিকা ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ 

[email protected] 

Comments

The Daily Star  | English

Dengue testing fees to remain Tk 50 in govt hospitals

DGHS issues circular extending the fixed charges for dengue tests till Dec 31

32m ago