পদক বিজয়ী ইঁদুর মাগাওয়া মারা গেছে

মাগাওয়া। বিশালাকৃতির আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ‘পাউচড’ ইঁদুর। তবে মাগাওয়া কোনো সাধারণ ইঁদুর নয়। বিস্ফোরকের রাসায়নিক উপকরণের গন্ধ শুঁকে অসংখ্য ভূমি মাইন খুঁজে বের করেছে মাগাওয়া। এই বীরত্বের জন্য তাকে বিশেষ পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল।

মাগাওয়া। বিশালাকৃতির আফ্রিকান বংশোদ্ভূত 'পাউচড' ইঁদুর। তবে মাগাওয়া কোনো সাধারণ ইঁদুর নয়। বিস্ফোরকের রাসায়নিক উপকরণের গন্ধ শুঁকে অসংখ্য ভূমি মাইন খুঁজে বের করেছে মাগাওয়া। এই বীরত্বের জন্য তাকে বিশেষ পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল।

'হিরো র‍্যাট' খ্যাত ইঁদুরটি গতকাল ১২ জানুয়ারি ৮ বছর বয়সে মারা গেছে।

মাগাওয়াকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল অ্যাপোপো নামে একটি অলাভজনক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও)। তারা জানিয়েছে, ইঁদুরটি তার জীবদ্দশায় ১০০টির বেশি ভূমি মাইন ও অন্যান্য বিস্ফোরক উপাদান খুঁজে বের করেছে। যেগুলো নিষ্ক্রিয় করে হাজারো মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।

অ্যাপোপো বিভিন্ন মানবতামূলক কার্যক্রমের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নের পাশাপাশি 'শনাক্তকারী ইঁদুর প্রযুক্তি' নিয়ে কাজ করে, যার মাধ্যমে ইঁদুরদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষিত ইঁদুরগুলোকে মাটিতে লুকিয়ে রাখা ভূমি মাইন খুঁজে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা ও রোগীদের দেহে যক্ষ্মা চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়।

বেলজিয়ামে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হলেও তানজানিয়া, অ্যাঙ্গোলা, কম্বোডিয়া, মোজাম্বিক ও ইথিওপিয়াতেও তাদের দপ্তর রয়েছে।

অ্যাপোপোর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তারা মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য ইঁদুরদের প্রশিক্ষণ দেন। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে শনাক্তকারী ইঁদুর প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা ও ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনকে অনুপ্রাণিত করা।

২০২০ সালে তার কাজের অবদান হিসেবে যুক্তরাজ্যের দাতব্য প্রতিষ্ঠান 'দ্য পিপলস ডিসপেনসারি ফর সিক অ্যানিমেলস (পিডিএসএ)' এর পক্ষ থেকে মাগাওয়াকে স্বর্ণ পদকে ভূষিত করা হয়।

গত মঙ্গলবার তার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে অ্যাপোপো একটি বিবৃতি দেয়। সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, 'আমরা গভীর শোকের সঙ্গে জানাচ্ছি, বীর ইঁদুর মাগাওয়া গত সপ্তাহান্তে শান্তিপূর্ণভাবে মারা গেছে। মাগাওয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা বেশ ভালো ছিল এবং সে গত সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় তার স্বভাবসুলভ উচ্ছলতায় খেলাধুলা করে কাটিয়েছে। তবে সপ্তাহের শেষের দিকে এসে তার কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। শেষ কয়েকটা দিন সে বেশি ঘুমাচ্ছিল আর খাবারের প্রতি অনাগ্রহ দেখাচ্ছিল। গত নভেম্বরে মাগাওয়ার অষ্টম জন্মদিন উদযাপন করা হয়।'

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মাগাওয়া অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে এবং তাদের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। 'অ্যাপোপো পরিবারের সবাই মাগাওয়াকে হারিয়ে বেদনার্ত এবং আমরা তার অসাধারণ অর্জনের জন্য কৃতজ্ঞ', বিবৃতিতে আরও যোগ করা হয়।

২০১৩ সালের নভেম্বরে তানজানিয়ার সোকোইন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাগাওয়ার জন্ম। সেখানেই তাকে বিস্ফোরক খুঁজে বের করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ৩ বছর পর সে কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপে চলে যায় এবং সেখানে তার কর্মজীবন শুরু হয়। মাগাওয়া কম্বোডিয়ার প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার বর্গমিটার ভূমিকে মাইনমুক্ত করেছে।

পাউচড ইঁদুর হচ্ছে প্রাণী জগতের ক্রাইসেটোমাইনি উপপরিবারের অংশ, যার সদস্যরা মূলত আফ্রিকায় বসবাস করে। এটি নেসোমাইডি পরিবারের একটি শাখা, যার অন্যান্য সদস্যের মধ্যে আছে সাদা লেজযুক্ত ইঁদুর, মালাগাসি ইঁদুর ও গাছ বেয়ে উঠতে পারে এ রকম আরেক জাতের ইঁদুর। সব নেসোমাইডি প্রাণীগুলো সুপার পরিবার মুরোইডিয়ার অংশ, যার মধ্যে পৃথিবীর সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর এক চতুর্থাংশ অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ইঁদুর বেশ বুদ্ধিমান এবং তাদের খুব সহজেই প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় বলে জানিয়েছে অ্যাপোপো।

পাউচড ইঁদুরগুলোকে সাধারণত আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে দেখা যায়। তবে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে এদের বিচরণ কম। এই ইঁদুরগুলোর চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ফোলা গাল। আকৃতিগত এই দিকটিই তাদের অন্য ইঁদুর থেকে আলাদা করে।

magawa_4.jpg

মাগাওয়ার ওজন এত কম ছিল যে সে কোনো মাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেও সেটি বিস্ফোরিত হতো না। পিডিএসএ জানিয়েছে, মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে টেনিস কোর্টের আকারের একটি ভূমিতে মাইন আছে কি না মাগাওয়া তা নিশ্চিত করতে পারতো। যে কাজ করতে একজন মানুষের সময় লাগে পুরো ৪ দিন।

বহু বছরের যুদ্ধের কারণে কম্বোডিয়ার বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য ভূমি মাইন খুঁজে পাওয়া যায়। অসাবধানবশত সেসব মাইনের ওপর পা পড়ে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে ভূমি মাইন একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে। প্রায় ৩ দশকের যুদ্ধের ফল হিসেবে দেশটির প্রায় ৪০ হাজার নাগরিক দেহের এক বা একাধিক অঙ্গ হারিয়েছেন। কম্বোডিয়ান মাইন অ্যাকশন অ্যান্ড ভিকটিম অ্যাসিস্টেন্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৯ সালে খেমার রুজ (কমিউনিস্ট পার্টি অব ক্যাম্পুচিয়া) সরকারের পতনের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৬৮ হাজার মানুষ ভূমি মাইন ও অন্যান্য বিস্ফোরকের বিস্ফোরণে হতাহত হয়েছেন। এ ছাড়া, দেশটিতে ১৯৯২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৬৩টি মাইন চিহ্নিত ও ধ্বংস করা হয়েছে।

কিছু বিশ্লেষকের অনুমান, দেশটিতে মাইন ও অন্যান্য অবিস্ফোরিত বিস্ফোরকের সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে ১ কোটিও হতে পারে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও খেমার রুজের শাসনামলে কম্বোডিয়ায় অসংখ্য ভূমি মাইন স্থাপন করা হয়েছিল। তবে ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সালে তৎকালীন সরকার হামলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে দেশের উত্তর পশ্চিমে থাইল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্তে 'কে ফাইভ বেল্ট' নামে পরিচিত এলাকায় মাইন বসায়।

এই উদ্যোগের কারণে কে ফাইভ বেল্ট পৃথিবীর সর্বাধিক ভূমি মাইন দূষণের শিকার হওয়া অঞ্চলে পরিণত হয়। প্রায় ১ হাজার ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ (৬৫০ মাইল) অঞ্চলে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২ হাজার ৪০০টি করে মাইন বসানো হয়। এই লাখো অবিস্ফোরিত ভূমি মাইনের কারণে দেশটিতে অঙ্গহানি হয়েছে এ রকম মানুষের সংখ্যা এত বেশি। দেশটিতে বছরে গড়ে ১০০টি ভূমি মাইন বিষ্ফোরণে দুর্ঘটনা ঘটে।

আধুনিক যুগে সামরিক বাহিনী কম্বোডিয়াকে মাইনমুক্ত করার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। তবে পল্লী অঞ্চলের নাগরিকরা তাদের এই উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখেনি বলে দ্য কনভারসেশন ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মত প্রকাশ করেছিলেন নিউ ইয়র্কের বিংহ্যামটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গণহত্যা ও নৃশংসতা প্রতিরোধ বিভাগের মেডিকেল নৃতত্ত্ববিদ ড. ডার্সি ডিএঞ্জেলো।

মাইন মুক্ত করার উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে জোর করে ভূমি দখল ও অন্যান্য অভিযোগ রয়েছে। তবে ভূমি মাইন মুক্ত করার কার্যক্রমে মাগাওয়া ও অন্যান্য ইঁদুর যোগ দেওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যায় বলে জানান ড. ডার্সি। অসাধারণ ঘ্রাণশক্তি, লালন-পালনের অপেক্ষাকৃত কম খরচ ও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সহজে পরিবহন করতে পারার কারণে মাইনমুক্ত কার্যক্রমে মাগাওয়ার মতো বীর ইঁদুরগুলো খুব জনপ্রিয় হয়।

magawa_1.jpg

মাইনক্ষেত্রে মাগাওয়াকে দুজন ডি-মাইনার বা মাইন মুক্তকরণ কর্মীর সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হতো। ইতোমধ্যে মাইন পরিষ্কার করা হয়েছে এ রকম জায়গা দিয়ে ওই দুই ব্যক্তি হেঁটে যেতেন আর তাদের মাঝ দিয়ে মাগাওয়া মাইনের রাসায়নিক উপকরণ খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যেত। টিএনটি (ট্রাই নাইট্রো টলুইন, হলুদ রঙের দাহ্য পদার্থ) বা এ রকম কোনো উপকরণের গন্ধ পেলে সে সেখানে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচাতে শুরু করতো। তখন মাইন মুক্তকরণ কর্মীরা সে জায়গাটিকে চিহ্নিত করে রাখতেন এবং পুরস্কার হিসেবে মাগাওয়াকে একটি কলা খেতে দিতেন।

magawa_2.jpg

মাগাওয়ার ওজন ১ থেকে ৩ পাউন্ডের মধ্যে হওয়ায় ভূমি মাইনের তুলনায় সে ওজনহীন বলেই বিবেচিত হতো। ন্যূনতম ১১ থেকে ৩৫ দশমিক ৩ পাউন্ড চাপ না পেলে এই মাইনগুলো সক্রিয় হয় না, জানান ড. ডার্সি।

ডগ স্কোয়াডের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মাইন খোঁজার দৃশ্য পল্লী অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতো, তার জন্য দায়ী কম্বোডিয়ার ইতিহাস। সেই নেতিবাচক ভাবমূর্তি অনেকাংশই দূর করতে সক্ষম হয়েছে অ্যাপোপোর হাসি-খুশি ইঁদুর বাহিনী এবং বিশেষ করে তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুশিক্ষিত ও চঞ্চল মাগাওয়া।

প্রাণী জগতের হিসেবে মোটামুটি সুদীর্ঘ ৫ বছরের ক্যারিয়ার শেষে গত বছরের জুন মাসে অবসর নিয়েছিল মাগাওয়া। তার প্রশিক্ষক ম্যালেন জানিয়েছিলেন, মাগাওয়ার গতি ধীর হয়ে যাচ্ছে এবং সে বার্ধক্যের দিকে আগাচ্ছে এবং তিনি তার 'ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানাতে চান'।

Comments

The Daily Star  | English

Will anyone take responsibility for traffic deaths?

The Eid festivities in April marked a grim milestone with a record number of road traffic accidents and casualties.

7h ago