চলে গেলেন কত্থক নৃত্যের প্রবাদপুরুষ পণ্ডিত বিরজু মহারাজ

বিরজু মহারাজ। ছবি: স্টার

তিনি যখন মঞ্চ উঠতেন চোখ তখন একনাগাড়ে সটান হয়ে থাকতো তার দিকে। একি মোহাচ্ছন্ন কবিতা, নাকি সুধাপানের সমাবেশ। নাকি তানসেনের সঙ্গীতের আসর।

তানসেন নাকি রাগ মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারতেন, দীপক রাগে ছড়াতে পারতেন বহ্নিশিখা। রাগের ওপর এতোটাই দখল ছিল তার। আর বিরজু মহারাজের ছিল শরীরের ওপর অবিশ্বাস্য দখল। যেন তিনি মাইকেলেঞ্জেলোর নিখুঁত চিত্রকর্ম। যেন তার লয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে গোটা পৃথিবী।

নৃত্যের সুচারু সব উদ্যম ও উপস্থাপনায় তিনি কত্থক নৃত্যকে পৌঁছে দিয়েছেন সর্বস্তরে। নাচকে যিনি উপস্থাপনার মাধ্যমে পরিচয় করিয়েছেন জীবনের নানা ভাঁজে। কিংবদন্তী সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাকে বলেছিলেন, 'তুমি তো লয়ের পুতুল।' এতোটাই অবিশ্বাস্য ছিলেন কালকা-বিনন্দাদিন ঘরানার কিংবদন্তী নৃত্য শিল্পী পণ্ডিত বিরজু মহারাজ।

তার পরিবার জানিয়েছে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজ। গতকাল রোববার রাতে ভারতের দিল্লির বাড়িতে নাতির সঙ্গে খেলছিলেন তিনি। সেই সময় আচমকাই অসুস্থ বোধ করেন। দ্রুত দিল্লির সাকেত হাসপাতালে তাকে নেওয়া হলেও চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গত কয়েক বছর ধরেই কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্মৌতে ১৯৩৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কত্থকের 'মহারাজা' পরিবারে জন্ম বিরজু মহারাজের। তাদের পরিবারে ৭ পুরুষ ধরে চলে কত্থক নাচের চর্চা। তার বাবা অচ্চন মহারাজ বিরজুর প্রথম গুরু হলেও তার ২ কাকা শম্ভু মহারাজ এবং লচ্ছু মহারাজ ছিলেন কত্থক নৃত্যের কিংবদন্তী।

মাত্র ৬ বছর বয়সেই বাবা অচ্চন মহারাজের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছিলেন বিরজু মহারাজ। কিন্তু ৯ বছর বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। তখন তাদের একমাত্র ভিটেও বিক্রি করতে হয়েছিল। কিন্তু তাতেও আপত্তি ছিল না। নাচকে কেন্দ্র করেই স্বপ্ন বুনতে থাকেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন নতুন করে।

তার ২ কাকাও ভাতিজাকে শিখিয়েছিলেন নৃত্যের নানান কলা। কৈশোরেই বিরজু মহারাজ পরিচিত হলেন গুরু হিসেবে। অতি দ্রুতই যেমন আয়ত্ত করেছিলেন তিনি ঠিক তেমনই ছিল তার শেখানোর কৌশল। তখন তিনি নৃত্য পরিবেশন করতেন রামপুরের নবাব পরিবারে। সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী হিসেবে মাত্র ২৮ বছরে পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার।

১৯৫২ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে মামার সঙ্গে প্রথম নাচতে কলকাতায় যান বিরজু মহারাজ। এরপর পড়ে যান এই শহরের নেশায়। কেবল নাচই নয়, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর দারুণ দখল ছিল বিরজু মহারাজের। দারুণ তবলা, বেহালা,  ড্রাম যেমন বাজাতে পারতেন, তেমনই ছবি আঁকাতেও ছিল তার অসম্ভব ভালো দখল। কণ্ঠসঙ্গীতেও ছিলেন তিনি অতুলনীয়। কিন্তু নাচই ছিল বিরজু মহারাজের প্রথম এবং শেষ প্রেম। নাচকেই জীবনের সাধনা বানিয়েছিলেন তিনি।

ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে মোট ১৭টি নৃত্যনাট্যের নির্দেশক ছিলেন বিরজু মহারাজ।

কোরিওগ্রাফার হিসেবে তিনি কাজ করেছেন বিখ্যাত বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে। সত্যজিৎ রায়ের 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' চলচ্চিত্রের 'কানহা মে তোসে হারি' গানের নাচে কোরিওগ্রাফি বিরজু মহারাজের করা। ২০০২ সালে নির্মিত 'দেবদাস' চলচ্চিত্রে 'কাহে ছেড়ে মোহে' গানে মাধুরী দীক্ষিতের সেই নাচের দৃশ্য যেমন আজো সবার চোখে ভাসে। এটির কোরিওগ্রাফি করেছিলেন বিরজু মহারাজ। 'বিশ্বরূপম' চলচ্চিত্রে কোরিওগ্রাফির জন্য পেয়েছিলেন ভারতের জাতীয় পুরস্কার।

বাংলাদেশের সঙ্গে সবসময়ই নিবিড় সম্পর্ক ছিল বিরজু মহারাজের। বেশ কয়েকবার এ দেশে এসেছিলেন তিনি। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উৎসবের আসরগুলোতে প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে ঢাকায় ছায়ানটে কত্থক নৃত্য সম্প্রদায়ের 'কত্থক নৃত্য উৎসব ১৪২৩' এ এসেছিলেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজ। সে উৎসবে তিনি বলেছিলেন নাচ নিয়ে তার চিন্তা, ভাবনা, দর্শন এবং সংগ্রামের কথা।

তিনি বলেন, 'দেখুন সারা দুনিয়াই নাচছে! এই দেখুন না, বাতাস নাচছে, চাঁদ নাচছে, পৃথিবী নাচছে, পাতা নাচে, ফুল নাচে। কৃষ্ণ বাঁশি বাঁজায়, শিব ডমরু বাঁজায়, নাচে তো বটেই। নৃত্য হলো জীবনের প্রতিস্থাপন। নাচ হলো কবিতার মতো। কবিতার মতো নাচ জীবন বোধের সৃষ্টি করে। সেই বোধ কেউ পায়, কেউ হয়তো পায় না।'

ভারতীয় কলাকেন্দ্র, কত্থককেন্দ্র, সংগীতভারতীসহ নানান জায়গায় তালিম দিয়েছেন এই কিংবদন্তী নৃত্য সাধক।  বাংলাদেশের শিবলী মুহম্মদ, মুনমুন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী ছিলেন বিরজু মহারাজের সরাসরি শিষ্য।

১৯৯৮ সালে দিল্লিতে নিজের কত্থক নৃত্যের স্কুল 'কলাশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন বিরজু মহারাজ।

Comments

The Daily Star  | English
Yunus-Rubio

Yunus, Rubio pledge to deepen economic ties

Bangladesh and the United States yesterday pledged to deepen economic ties and reaffirmed commitment to a stable and peaceful Indo-Pacific region. 

2h ago