দূষণ, অবহেলায় যে নদী হারিয়েছে তার রং

ডায়িং কারখানা বর্জ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর পানির নয়টি মানসূচকে অবনমন হয়েছে।
বুড়িগঙ্গা নদীর এই ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: আনিসুর রহমান/ স্টার

ডায়িং কারখানা বর্জ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর পানির নয়টি মানসূচকে অবনমন হয়েছে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ডাইং কারখানার বর্জ্য নিঃসরণ পয়েন্ট থেকে নেওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর পানির নমুনায় দূষণের মাত্রা আদর্শ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।

তিনটি প্রতিষ্ঠান গতকাল মঙ্গলবার যৌথভাবে নদীর পানির গুণাগুণ এবং এতে ডাইং কারখানার প্রভাব নিয়ে করা সমীক্ষা প্রকাশ করেছে।

প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো- স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ।

সমীক্ষায় দেখা গেছে যে প্রাক-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা-পরবর্তী মৌসুমে পানির পিএইচ মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৬, ৬ দশমিক ৭ ও ৮ দশমিক ৫। এ ক্ষেত্রে ৭ কে মানদণ্ড ধরা হয়।

সমীক্ষায় জানা গেছে, পানিতে মোট ভাসমান অদ্রাব্য পদার্থের (সাসপেন্ডেড সলিড) পরিমাণ ছিল সাধারণ মানদণ্ড ১০ এর বিপরীতে প্রতি লিটারে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫ লিটার। প্রতি লিটারে রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা (সিওডি) ছিল ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬ মিলিগ্রাম, যার মানদণ্ড ৪।  সাধারণ মানদণ্ড শূন্য দশমিক ২ মিলিগ্রামের বিপরীতে জৈবিক অক্সিজেনের চাহিদা (বিওডি) ছিল প্রতি লিটারে ৮৭, ৭২ ও ১০৬ মিলিগ্রাম।

পোস্তগোলা সেতু থেকে মেরি অ্যান্ডারসন পয়েন্ট পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা তীরের পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে কয়েক ডজন ডাইং কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে ১০০র চেয়েও বেশি ট্যানারি স্থানান্তরের পর এই কারখানাগুলোকেই এখন বুড়িগঙ্গা নদী দূষণমুক্ত রাখার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

হাইকোর্টের একটি আদেশের পর, পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) গত বছরের শুরুর দিকে শ্যামপুর-কদমতলী এলাকার অন্তত ৫০টি কারখানার পানি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সরবরাহ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় যাতে তারা বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করতে বাধ্য হয়।

তবে হাইকোর্ট ২০২১ এর মাঝামাঝি সময়ে কারখানাগুলো ইটিপি স্থাপনের পর পরিসেবার সংযোগ পুনস্থাপন করার জন্য ডিওইকে নির্দেশ দেয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, তারা আশা করেছিলেন ডাইং কারখানায় ইটিপি বসানো হলে পানির গুণগত মানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিন্তু দুঃখজনকভাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বুড়িগঙ্গার পানির গুণগত মান সাধারণ মানদণ্ডের কাছাকাছিও নেই।'

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সিওডি, টিএসএস, পিএইচ, গ্রীজ ও তেল, নাইট্রোজেন এবং ফেনলসহ নদীর পানির গুণগত মানের প্রতিটি নিয়ামকের পরিমাণ সাধারণ মানদণ্ডের মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। এটি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে।

২০১৫ সালে প্রকাশিত ডিওইর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৮০ থেকে ১০০টি কারখানা প্রতি সেকেন্ডে আনুমানিক ৬০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নদীতে ছেড়ে দেয়। এর পেছনে বর্জ্য নিষ্কাশনের অপারগতা ও অবহেলাই মূলত দায়ী।

গতকাল মঙ্গলবার দোলেশ্বর ঘাট এলাকা থেকে শ্যামপুরের ফায়ার সার্ভিস ঘাট পর্যন্ত নদীর একটি অংশ সরেজমিনে পরিদর্শন করে এই প্রতিবেদক দেখতে পান দোলেশ্বর ঘাটের সিঁড়ির নিচ দিয়ে কারখানার বর্জ্য নদীতে পড়ছে।

পুরো এলাকায় খুব বাজে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল, যেটি যে কোনো মানুষের দম বন্ধ করে দিতে পারে। লক্ষ্য করা যায়, কিছু কিছু অংশে নদীর পানির রঙ গোলাপি হয়ে গেছে।

বাপার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী সদস্য এবং বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার সংগঠক হানিফ শরীফ বলেন, পানির সংস্পর্শে আসা অনেকেই চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

তিনি জানান, বর্জ্য নিঃসৃত হয় এরকম ভূগর্ভস্থ পাইপগুলো উপড়ে ফেলতে হবে। শ্যামপুর-কদমতলী এলাকায় এ ধরনের প্রায় ৬৫টি পাইপ আছে, যোগ করেন তিনি।

বাপার শরীফ জামিল বলেন, পোশাক খাত দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হওয়ায় ডাইং কারখানা বন্ধ করে দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না।

তিনি মত প্রকাশ করেন, 'সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ক্লাস্টার ইটিপি রয়েছে। অবশ্যই কালারজেন প্রযুক্তি চালু করতে হবে যাতে কাপড়ে রং দেওয়ার সময় কোনো বর্জ্য নির্গত না হয়। এটা করা না হলে কারখানাগুলো নদীর পানিকে দূষণমুক্ত করার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হিসেবে থেকে যাবে।'

২০১৫ সালে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ হাইকোর্টে ডাইং কারখানার দূষণ বন্ধ করার জন্য একটি রিট আবেদন করেছিলেন। তিনি জানান, আদালত ইটিপি নেই এরকম সব কারখানার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও ভূগর্ভস্থ পাইপগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ডিওইকে নির্দেশ দিয়েছে।

ডিওই পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী বলেন, তার বিভাগ গত বছর ইটিপি নেই এরকম কারখানার বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে।

তিনি জানান, পরবর্তীতে কারখানা মালিকরা কমপ্লায়েন্স প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর আদালত তাকে সংযোগ পুনস্থাপনের নির্দেশ দেয়।

কর্মকর্তা জানান, সব নিয়ম সঠিক মত মেনে চলা হচ্ছে কী না, তা নিশ্চিত করতে তারা নিয়মিত কমপ্লায়েন্স অভিযান পরিচালনা করেন।

তিনি আরও জানান, 'আমরা শ্যামপুরে ছয়টি ডাইং কারখানা এবং একটি রি-রোলিং মিল বন্ধ করে দিয়েছি। সমস্যা হল, আমরা একটি কারখানায় অভিযান চালালে বাকিরা তাদের কারখানা বন্ধ করে দেয়। কিছু কারখানার মালিক মাঝে মাঝে ইটিপি চালায় না এবং এ বিষয়টি আমাদের জানা আছে। তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি করার জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ জনবল নেই।'

মন্তব্যের জন্য শ্যামপুর ডাইং ফ্যাক্টরি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

তবে অ্যাসোসিয়েশনের দপ্তর সম্পাদক মেহেদী মোকাম্মেল দাবি করেছেন, তারা ইটিপি চালু রেখেছেন।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

19h ago