কৈশোর-তারুণ্য রাঙানো ‘সেবা’

ঠিক ৩ দশক আগের কথা। সময়টা ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭। সবে কৈশোরে পা দেওয়া স্কুলের শিক্ষার্থী একদল ছেলে-মেয়ে উত্তেজনা নিয়ে বসে থাকে, কবে বের হবে 'তিন গোয়েন্দা'র নতুন বই। তাদের কল্পনা জুড়ে কিশোর, মুসা, রবিন।

একটু বড় হতেই তারা অপেক্ষা করে 'মাসুদ রানা' আর 'কুয়াশা'র জন্য। সেগুলো পড়তে পড়তে ঘুরে বেড়ায় দেশে-বিদেশে। নানান বিদেশি অনুবাদ কিংবা ওয়েস্টার্ন সিরিজ পড়তে পড়তে স্বপ্নের ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ায় কোনো খামারে।

বলছি নিজের কথা, আমাদের কথা। আসলে আমাদের শৈশব কৈশোর মানেই ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন এবং তার সেবা প্রকাশনী। তার চলে যাওয়া তাই আমাদের ভীষণ আলোড়িত করে। মনে হয়, আমাদেরই কোনো স্বজন বুঝি চলে গেলেন। কারণ আমাদের বেড়ে ওঠা আর আমাদের বড় হওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেবা প্রকাশনী।

নব্বইয়ের সেই দিনগুলোর কথা আজো মনে আছে। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রামের আনোয়ারার এক সরকারি কলোনীতে থাকি। সেখানেই স্কুল। টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট বা গেমস নয়, আমাদের শৈশবকে ভীষণভাবে রাঙিয়েছিল এই সেবা প্রকাশনী। একেকটা নতুন বইয়ের জন্য মাস শেষে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম।

অবশ্য আমার বই পড়া শুরু হয়েছিল আরেকটু আগে, কমিকস দিয়ে। চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিংকি, নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট কিংবা হাঁদা ভোঁদা দিয়ে। ক্লাস ওয়ান-টু-থ্রি আমাদের কমিকস পড়েই কেটেছে। ক্লাস ফোর-ফাইভে ওঠার পর নিজেদের একটু বড় মনে হতে থাকলো। কারণ ততোদিনে আমাদের হাতে চলে এসেছে তিন গোয়েন্দা।

আহা! কি স্বর্নালী সেই দিনগুলো। চারপাশের সবকিছু অন্য দৃষ্টিতে দেখি। মনে হয় সব রহস্য। ক্লাস ফোর-ফাইভ-সিক্স তিন গোয়েন্দায় কাটলো। স্কুলের পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়ি। এমনও হয়েছে বাথরুমে পানি ছেড়ে দিয়ে বালতি উল্টে বসে তিন গোয়েন্দা পড়েছি। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে নিজেকে কিশোর গোয়েন্দা ভেবেছি। আজও তিন গোয়েন্দা সিরিজের বইয়ের নামগুলো সিরিয়ালি মুখস্থ বলতে পারবো অনেকটা।

সেবা প্রকাশনীর সূত্রেই এই তিন গোয়েন্দা পাওয়া। যারা চট্টগ্রামে থাকেন তারা হয়তো মনে করতে পারবেন, নব্বইয়ের দশকে যখন চট্টগ্রামের নতুন রেলস্টেশন হয়নি তখন পুরনো রেলস্টেশন ভবনের নিচতলায় দুটো বইয়ের দোকান ছিল। সেই দোকানে সাজানো থাকতে কমিকস আর সেবা প্রকাশনীর বই। আমাদের গাড়ি শহরে আসলে স্টেশনের সামনে থাকতো। আর এই ২ দোকান থেকে আমরা বই কিনতাম। কিন্তু শহরে তো নিয়মিত যাওয়া হয় না। নিয়মিত বই কোথায় পাবো? তিন গোয়েন্দার বই পড়ার জন্য আমরা স্কুলের ৫ বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে সেবা প্রকাশনীর গ্রাহক হয়ে গেলাম। নতুন বই প্রকাশ হলেই তারা আমাদের পাঠিয়ে দিত ডাকে। আমরা অপেক্ষা করে থাকি কবে আসবে সেই বই।

প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে ক্লাস সিক্সে ওঠার পর হাতে পেলাম কুয়াশা সিরিজ। ওরে বাবা! এতো রীতিমত অ্যাডভেঞ্চার। তিন গোয়ন্দাকে মনে হলো বাচ্চাদের বই। এরপর শুরু হলো কুয়াশা সিরিজ। প্রায় একই সময়ে হাতে এলো মাসুদ রানা। সিক্স-সেভেন এই কুয়াশা-মাসুদ রানা-সোহানার ঘোরেই কাটলো। এরপর বেশ কিছু অনুবাদও পড়েছি। সেবার ক্লাসিক আর অনুবাদগুলো আমাদের বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তারপর জাফর ইকবাল, হুমায়ুন আহমেদ হয়ে সুনীল, শীর্ষেন্দু-সমরেশরা। কিন্তু আজো মনে হয় কাজী আনোয়ার হোসেন আর সেবা-ই বোধ হয় আমাদের শৈশবের সবচেয়ে বড় আনন্দের নাম। আমি নিশ্চিত সারা দেশে আমাদের মতো তরুণ-কিশোরের অভাব নেই। কাজী আনোয়ার হোসেন ও সেবা তাই সবসময়ই আমাদের কাছে একটা ভালোবাসার নাম।

সেবা প্রকাশনীর প্রতি এতোই ঘোর ছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেগুনবাগিচায় সেবা প্রকাশনীতে গিয়েছি দেখা করতে। চোখের সামনে সেবা প্রকাশনীর অফিস দেখে মুগ্ধ হয়েছি। সারা জীবন নিভৃতে থাকা কাজী আনোয়ার হোসেনকে যখন ফেসবুকে বন্ধু হিসেবে পেলাম, ভীষণ ভালো লেগেছিল। আমাদের সবার প্রিয় সেই কাজীদা গতকাল বুধবার চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে।

কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই, ঢাকায়। তার বাবা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মা সাজেদা খাতুন। কাজী আনোয়ার হোসেনরা ১১ ভাই-বোন। নানান কারণেই এই পরিবারটার কাছে বাংলাদেশ ঋণী। সেটা হোক কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে কিংবা তার বোন ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সনজীদা খাতুনের কাছে কিংবা অন্য যে কারো কাছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাজী আনোয়ার হোসেন কিংবা সেবা প্রকাশনীর অবদান কতোটা বিশাল তা বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৬৩ সালে কাজী আনোয়ার হোসেন প্রথমে সেগুনবাগিচায় প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালের জুনে প্রকাশিত হয় সেগুনবাগান প্রকাশনীর প্রথম বই 'কুয়াশা-১'। পরে প্রকাশনীর নাম পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী। এরপর সেই ষাটের দশক থেকে গত ৫০ বছরে কিশোর থেকে তরুণ কতো মানুষকে বই পড়া শিখিয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। আমার তো মনে হয় তিনি আমাদের আসলে মানুষ বানাতে চেয়েছেন। সৃজনশীল, অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় দেশপ্রেমিক এবং মানবিক মানুষ, যারা নিজ দেশ আর দুনিয়া গড়বে। আজকের দিনে এই মানুষের যে ভীষণ অভাব! কাজী আনোয়ার হোসেন আর তার সেবা প্রকাশনীর কাছে তাই কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। পরপারে ভালো থাকবেন প্রিয় কাজীদা।

শরিফুল হাসান, কলামিস্ট

Comments

The Daily Star  | English

Israeli strike hits military base south of Tehran: Iran media

An Israeli attack on Saturday in Iran's west killed at least five army personnel and wounded nine others, Iranian media reported

20m ago