‘চাষাভুষাদের’ যা খুশি তাই বলা যাবে?

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ‘অশালীন মন্তব্যের’ অভিযোগ তুলে গতকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক মানববন্ধন করেন। এসময় অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুন বলেন, ‘আমরা চাষাভুষা নই যে, আমাদের যা খুশি তাই বলবে।’ ছবি: সংগৃহীত

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে 'অশালীন মন্তব্যের' অভিযোগে করা মানববন্ধনে অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুন বলেন, 'আমরা চাষাভুষা নই যে, আমাদের যা খুশি তাই বলবে।'

গতকাল বুধবারে আয়োজিত মানববন্ধনে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, 'আমরা সাধারণ শিক্ষক। আমরা সম্মানের জন্য কাজ করি এবং সম্মানের জন্যই এ পেশায় এসেছি। আমরা চাষাভুষা নই যে, আমাদের যা খুশি তাই বলবে।'

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য শাবিপ্রবির শিক্ষক অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুনের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের ঢাকা অফিস ও সিলেট অফিস থেকে গত ২ দিনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেখ আদনান ফাহাদ।

অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুনের সেই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ধরনের বক্তব্য একজন শিক্ষকের মুখে বের হবে এটা খুবই দুঃখজনক। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেসব ভুল চিন্তা আছে সে সব বিষয়ে সঠিক চেতনা তৈরি করা। শিক্ষার্থীদের যাতে শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়, দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় এগুলো শিক্ষকের কাজ।'

তিনি বলেন, 'যে শিক্ষক এ কথা বলেছেন তিনি আসলে জানেন না বাংলাদেশে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কি যে সব বাংলাদেশিরা দেশের বাইরে শিক্ষকতা করেন কিংবা বড় ধরনের গবেষক তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই চাষাভুষার সন্তান। আমাদের পুরো অস্বিত্বটাই চাষাভুষাদের ওপর নির্ভর করে। চাষাভুষা গালি না। এটা সম্মানের নাম।'

কৃষকের প্রতি অসম্মান জানানো মানে বাংলাদেশের প্রতি অসম্মান জানানো উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'দেশের প্রতি অসম্মান জানালে একজন শিক্ষকের কী যোগ্যতা থাকতে পারে তা প্রশ্নযোগ্য। একজন শিক্ষক যে বিষয় পড়ান না কেন তার ন্যূনতম কিছু বোধ থাকতে হবে। নিজের সঙ্গে এবং দেশের সঙ্গে মনোজগতের সম্পর্ক থাকতে হবে। দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালনার অঙ্গীকার থাকতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'চাষাভুষাকে ঘৃণা করার মধ্যে দিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয় সেই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাংলাদেশে বর্তমানে নানা রকম সমস্যা-সংকট তৈরি হয়েছে। এই ধরনের শিক্ষকরা বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করছেন। তাদের এই উপলব্ধি আসতে হবে যে, তারা নিজের অস্তিত্বের প্রতিই ঘৃণা জানাচ্ছে। নিজেদের বাবা-মার প্রতি ঘৃণা জানাচ্ছে, নিজের দেশের প্রতি ঘৃণা জানাচ্ছে। তার উপলব্ধি আসা উচিত যে এটি তার বড় ভুল। এর জন্য তার ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।'

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন বলেন, 'বাংলাদেশ কৃষকদের দেশ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি নিজেদের বিবেচনাবোধ বজায় না রাখেন, বিবেচনাবোধ জিনিসটা যে তাদের আছে আমরা যদি সেটা দেখতেই না পাই, তাহলে আর কী বলা যায়?'

তিনি বলেন, 'আন্দোলন করা ছেলে মেয়েরা যে অবস্থায় আছেন কেউ ক্ষোভের কারণে কিছু বললে সেটাকে আমি অসম্ভব কিছু মনে করি না। কিন্তু তার চাইতে অনেক বেশি বিবেচনা করার বিষয় হলো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে আচরণ করছেন কিংবা এই শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীরা যে না খেয়ে শীতের মধ্যে বসে আছেন সেটি নিয়ে কথা বলছেন না। তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি করছেন। শিক্ষার্থীরা যদি কোনো ভুল করে থাকেন তাদের সঙ্গে আমরা কি পাল্টাপাল্টি করবো? তারা তো আমাদের সন্তানদের মতো। আমরা উপাচার্যের পক্ষ হয়ে তাদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি করছি। এটা অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি।'

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান তুহিন ওয়াদুদ বলেন, 'চাষাভুষার মাধ্যমে এক শ্রেণির মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। শিক্ষার্থীরা যদি কোনো অসদাচরণ করে থাকেন তাহলে শিক্ষকদের উচিত তাদের সঙ্গে কথা বলা। কারণ তারা আমাদের সন্তানের মতো। তারা ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক।'

তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীরা যদি কোনো ভুল করে থাকে তার ব্যর্থতা শিক্ষকদেরই নিতে হবে। কারণ তাদের যেভাবে গড়ে তোলার কথা আমরা সেভাবে গড়ে তুলতে পারিনি। শিক্ষার্থীরা শিখতে এসেছেন। আর শিক্ষকরা কোন ভূমিকায় থাকেন তা তো আমরা দেখছি। কারা কারা কী ধরনের মন্তব্য করছেন আমরা তা দেখছি। উপাচার্য কী ধরনের মন্তব্য করছেন তাও আমরা দেখছি। শিক্ষকরা যখন সেসব নিয়ে কথা বলেন না, তখন বলতে হবে সেখানকার শিক্ষকরা যারা এসব কথা বলছেন তারা একপেশে। তারা নিরপেক্ষ নন। একটি পক্ষের হয়ে তারা সাফাই গাইছেন।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক শেখ আদনান ফাহাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা-মৌলিক চাহিদাগুলোর প্রাধিকার-ভিত্তিক তালিকা করলে দেখা যায় চাষারাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। কিন্তু আমরা সচেতনভাবেই কৃষক সমাজকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে জানি না। এটা আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির বড় সমস্যা। আধুনিক শিক্ষা আমাদেরকে কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে পারেনি।'

Comments

The Daily Star  | English
sirens sound in israel after iran missile attack

Attacking military infrastructure in Western and Central Iran: Israeli military

Trump to decide within two weeks on possible military involvement

20h ago