একজন কাজীদা আর একটি নিটোল শব্দের স্মৃতি

সেবা প্রকাশনীর জনক কাজী আনোয়ার হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই। অবশ্য আমি অন্যদের মতো করে বলবো না যে, তাকে হারিয়েছি। একভাবে চিন্তা করলে আমরা আসলে তাকে সব সময় পেয়েছি আর তার রেখে যাওয়া প্রকাশনা সংস্কৃতির মাঝে ভবিষ্যতেও তাকে পাব।
কাজী আনোয়ার হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

সেবা প্রকাশনীর জনক কাজী আনোয়ার হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই। অবশ্য আমি অন্যদের মতো করে বলবো না যে, তাকে হারিয়েছি। একভাবে চিন্তা করলে আমরা আসলে তাকে সব সময় পেয়েছি আর তার রেখে যাওয়া প্রকাশনা সংস্কৃতির মাঝে ভবিষ্যতেও তাকে পাব।  

একজন প্রকাশক আর লেখক হিসেবে, ব্যক্তিগতভাবে অচেনা থেকেও সর্বস্তরের বাংলাদেশি পাঠকদের মাঝে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন একটি বিশেষ কিছু, যাকে আমি বলতে চাই নানা স্বাদের মনের খোরাক। জটিল, নাক উঁচু করা সাহিত্য সমাবেশ আর প্রাতিষ্ঠানিক চাপের বাইরে থেকে, তিনি আমাদের অক্লান্ত দিয়ে গেছেন সাধারণ, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ আর রোমাঞ্চ, মিটিয়েছেন আমাদের নানা ধরনের কৌতুহল। 

কে জানে, হয়তো তার কারণেই আজ হাজার হাজার বাংলাদেশি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, নিজেদের অবচেতনে সেবা প্রকাশনীর কোনো বইয়ে পড়া স্বপ্নের সুতো ধরে। ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে তার প্রকাশনার মাধ্যমে। হোক তা রোমাঞ্চ, গোয়েন্দা কাহিনী, কিংবা চিরায়ত সাহিত্যকর্মের উপভোগ্য অনুবাদ। গতানুগতিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে, তার প্রকাশিত বইগুলো আমাদের নিয়ে গেছে দেশ দেশান্তরে, কল্পনায় দেখেছি আমরা উম্মুক্ত আকাশের নিচে নিঃসঙ্গ অশ্বচারী কাউবয়, চার্লস ডিকেন্সের লন্ডন আর রবিনহুডের শেরউড জঙ্গল। খুঁজেছি সলোমনের গুপ্তধন, রাইডার হ্যাগার্ডের আয়েশার প্রেম কিংবা মুচকি হেসেছি মার্ক টোয়েইনের টম সয়ারের অবাধ্য দুষ্টুমিতে। এরিক মারিয়া রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী উপন্যাসের শেষ পাতায়, যুদ্ধহীন পৃথিবীর পথ চেয়ে উড়ে চলা সেই প্রজাপতিটি আজও আমাদের অনেকের হৃদয় নাড়া দিয়ে যায়, আর তা এই সেবা প্রকাশনীরই কল্যাণে। এর বড় একটি কৃতিত্ব কাজীদার। তার এই বিদায় বেলায় আমি কিছু একমুখী আলাপ করব ভাবছি।

যদিও কাজীদাকে আমি সামনাসামনি দেখেছি আর কথা বলেছি হাতে গোনা কয়েকবার। তিনি আমাকে ভালো চিনতেন বললে ভুল হবে। কিন্ত আমার জীবনের এক অস্থির সময়ে, মাত্র তারুণ্যে পা দেওয়া নতুন লেখক হিসেবে, রহস্য পত্রিকার অফিস আর সেবা প্রকাশনী ছিল এক ধরনের দ্বীপের মত। তার ব্যস্ত জীবনে কত মেধাবী আর গুরুত্বপূর্ণ লোকজন এসেছে আর চলে গেছে! আমার জন্য বিষয়টি অবশ্য একটু আলাদা। ব্যক্তি হিসেবে কাজীদা, হয়তো নিজের অজান্তে, ক্ষণিকের জন্য হলেও আমাকে ইতিবাককভাবে প্রভাবিত করেছেন।

আমি কাজীদার সঙ্গে সামনাসামনি প্রথম কথা বলি কোন এক বই মেলার সন্ধ্যায়। ১৯৯৪ বা ৯৫ সালে। হাল্কা জ্যাকেট পরা তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, মাসুদ রানার কাহিনীগুলোর পেছনে বাস্তব কিছু আছে কি না। তিনি শান্তভাবে মাথা নেড়ে একটু মুচকি হেসে বললেন, না সবই কাল্পনিক। শুনে একটু যে দমে যাইনি বললে মিথ্যে হবে। যাই হোক, আমার হাতে ছিল সেবার দুটি পেপারব্যাক বই, 'অশনি সংকেত' আর 'শেষ অশনি সংকেত'। অটোগ্রাফ চাইলাম। নীরবে দুটি বইতে লিখে দিলেন তার শুভেচ্ছাবাণী আর দ্রুত-দক্ষতায় সই করলেন- *কা.আ. হোসেন*।

আমি ইতোমধ্যেই তার রহস্যপত্রিকায় লেখা শুরু করেছি, আর আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় সেখানেই। চুনোপুঁটি, নতুন, নামকাওয়াস্তে লেখকদের তার চেনার বা মনে রাখার কথা নয়। সাধারণত  রহস্যপত্রিকা কবিতা জাতীয় ব্যাপারটি এড়িয়ে চলতো, ছাপাতে চাইতো না। সে সময়ের নির্বাহী সম্পাদক মহিউদ্দিন ভাইও কবিতার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতেন। কিন্ত যা আছে কুল কপালে, নিয়ে গেলাম এক সন্ধ্যায় একটি কবিতা, দেখানোর জন্য। প্রয়াত শেখ আব্দুল হাকিম তখন সেই অফিসে নিয়মিত বসতেন আর বসতেন রকিব হাসান, তাদের টেবিল দুটো ছিল পাশাপাশি। দেরি করে ধীর পায়ে মাঝে মাঝে আসতেন শিল্পী ধ্রুব এশ। মৃদুভাষী স্ফিংস হয়ে বসে থাকতেন মহিউদ্দিন ভাই।  শেখ হাকিম কাজীদাকে শ্রদ্ধা করতেন খুব, বিশেষ করে বলতেন কীভাবে 'উনি' অল্প শব্দে বড় একটি দৃশ্য ধরে ফেলতে পারেন। 

যাহোক, হাকিম ভাই কবিতাটি পড়লেন আর আমায় অবাক করে দিয়ে বললেন, 'এত দারুন হয়েছে, কবিতাটা এই সংখ্যায় ছাপাতে হবে।' মুশকিল হলো, হাতে সময় কম আর কাজীদার অনুমতি লাগবে।  কাজী আনোয়ার হোসেন তখন একই বিল্ডিংয়ে থাকতেন মনে হয়। হাকিম ভাই সেই সন্ধ্যায় (রাত বলা যায়) কাজীদার কাছে আমার গোবেচারা কবিতাটি নিয়ে গেলেন এবং আমি দুরুদুরু বুকে অপেক্ষায় রইলাম চেয়ারে বসে। একটু পর ফিরে এসে হাকিম ভাই বললেন, 'উনি বলেছেন ঠিক আছে, ছাপা হবে।' আর সেই 'উনি' হচ্ছেন কাজীদা। কবিতার নাম মনে আছে, 'সহজিয়া সুরে', তবে কোন সংখ্যার রহস্য পত্রিকা তা মনে নেই আজ। লিখেওছিলাম ছদ্মনাম দিয়ে আর সম্মানী ছিল বোধহয় ৬০ বা ১০০ টাকার কাছাকাছি। কিন্ত আজ আমি, এতদিন পর, একধরনের গর্ব নিয়ে বলতে পারি যে কাজী আনোয়ার হোসেন আমার বড় সাদামাটা একটি কবিতা নিজে হাতে নিয়ে পড়েছেন, আমার নিজের হাতের লেখা একটি পাতা। আর তার কারণেই আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় একটি নিয়মিত মাসিক পত্রিকায়।

রহস্য পত্রিকার অফিসে তাকে দেখেছি একবার, রাতে এসেছিলেন কিছু সংশোধনী কাজের জন্য। আমি গল্প করছিলাম শেখ আব্দুল হাকিম আর রকিব হাসানের সঙ্গে। আসলে তারা কথা বলছেন আর আমি শুনছি; আমার তখন কতই বা বয়স মাত্র, উনিশ বা বিশ হবে হয়তো। এ বয়সে তাদের সান্নিধ্যকে আড্ডা দেওয়া বললে নিজেকে নিয়ে বেশি বলে ফেলা হবে। আমার সালাম শুনে কাজীদা সেদিন মুখ ফিরিয়ে বললেন 'কেমন আছেন?' আমার উত্তর খুব সংক্ষেপের এক জড়তাপূর্ণ 'জ্বী।'

এবার একটি অন্যরকম এবং আমার জন্যে কিছুটা বিব্রতকর এক স্মৃতি।                                                                                                                ক'মাস পরের কথা। আমি যুক্তরাষ্ট্রে আসার চেষ্টা শুরু করেছি তখন, কিন্ত টাকা নেই হাতে। ঠিক করলাম ঢাকায় যাদের সত্যি সত্যি শ্রদ্ধা করি, তাদের কাছে ধার চাইব। কাজীদা ছিলেন সেই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের তালিকার একজন। নিজের পাগলামিকে প্রশ্রয় দিয়ে, ২৪/৪ সেগুন বাগিচার ঠিকানায় কাজীদার কাছে পাঠিয়ে দিলাম আমার অনুরোধপত্র। আমাকে এক সেমেস্টারের টাকা ধার দেওয়ার অনুরোধ আর প্রতিজ্ঞা যে তার সাহায্য আমি গতর খাটিয়ে আয় করে ফিরিয়ে দেব। এরকম চিঠি আরও কিছু পাঠিয়েছি অন্যান্যদের প্রতি। আন্দাজ করতে পারছেন যে খুব একটা লাভ হয়নি। নিজের খেয়ালিপনা ভাবলে এখন হাসি পায়। যাদের কাছে লিখেছি তারা সবাই ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই নীরব কিন্ত সেই নীরবতার মাঝে ছিল একটি ব্যতিক্রম।

কিছুদিন পর ডাক পিওনের হাতে বন্ধ এক খামে, এলো একটি হাল্কা চিরকূট।
প্রেরকের নাম নেই, শুধু আমার ঠিকানা। 

খুলে দেখি, বেশ পটু হাতে, কালো কালিতে লেখা তিনটি লাইন-

*আমি অপারগ।*
*দুঃখিত।*
*তোমার আন্তরিক শুভকামনা করি।*
আর সই করেছেন,
                  *কা. আ. হোসেন*

নানাজনের কাছে এই ছেলেমানুষী আবদারের মতো করে আর্থিক সহায়তা চাইলেও, তাদের ভেতরে একমাত্র তিনিই উত্তর দেন। আর তাতে ছিল একধরনের নীরব উৎসাহ, সামনে যাবার। আমার একটু মন খারাপ হয়েছিল তার না সুলভ উত্তর পেয়ে। একই সঙ্গে হৃদয়ে জেগেছিল এক অন্যরকম ভালোলাগা, নতুন এক আবিষ্কারের মুখোমুখি হলে যে ধরনের ভালোলাগা জাগে, সেরকম। কাজীদা সেদিনের সেই সামান্য উত্তরে যতটুকু সরল স্বল্পতা আর নির্মল নিরপেক্ষতা নিয়ে ওই না বাচক বার্তাটুকু প্রকাশ করেছেন, সেখানে এক শাব্দিক আর কাব্যিক সৌন্দর্য্য ছিল। ওই শাব্দিক সামঞ্জস্য আর তার সৌন্দর্য্য আমাকে সেদিন ছুঁয়ে গেছে এবং আজও যায় মাঝে মাঝে।

এখন আমি আমেরিকায়, কাজীদার পারিপার্শ্বিকতা আর তার সাংস্কৃতিক আবহের থেকে অনেকদিন ধরে অনেক দূরে আছি। হাজার হাজার মাইল আর দু যুগের দূর প্রান্তে হারানো এক তরুণকে তার মনে রাখার কথা নয়। কিন্ত তাকে, সেবা প্রকাশনীর কাজিদাকে সেই তরুণ মনে রেখেছে প্রবাসের নানারকম অস্থির ঝঞ্ঝাটে আর বেঁচে থাকার দারুণ বাধ্যতার মাঝেও। বিশ্বসাহিত্যের পথে আমার প্রজন্মের বেশীরভাগের যাত্রা শুরু হয়েছে সেবা প্রকাশনীর বই দিয়ে। আমরা জেনেছি অন্য দেশ, অন্য মন আর অন্য মনন। আর জেনেছি তা নিরুপম স্বচ্ছন্দতায়, তথাকথিত সিরিয়াস সাহিত্যের নিপীড়ন থেকে নিরাপদ ব্যাবধানে থেকে।

সেই প্রজন্মের পক্ষ থেকে তাকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা। আর বহুবছর আগের সেই ছোট্ট উত্তরের জন্য জানাই আমার একান্তই নিজস্ব, হৃদয় ছোঁয়া কৃতজ্ঞতা। বড় সাধারণ আর আপাত দৃষ্টিতে নেতিবাচক 'অপারগ' শব্দটির মাঝে যে এক ধরনের অনবদ্যতা লুকিয়ে থাকতে পারে, শব্দটি নেতিবাচক হয়েও যে সাথী হতে পারে কোনো শুভেচ্ছার, তা আমি প্রথম জেনেছি এবং অনুভব করেছি কাজীদার নিজ হাতে লেখা সেই ছোট্ট চিরকুটে। ভাঁজ করা কাগজটা আজ কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে; তবে যা হারিয়ে যায়নি আমার মনে, তা হচ্ছে কোনো এক অচেনা তারুণ্যের স্বপ্নকে বিব্রত না করে, নাকচ না করে কীভাবে না বলা যায়, তার নিটোল একটি উদাহরণ।  

আমাকে লেখা খামে কাজীদার কোন ঠিকানা ছিল না। আজ উনি কোথায় তারও নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই।  তারপরও আমি আশা করছি, মেঘের রহস্যে ঘেরা কোনো বইমেলায়, তার শান্ত গাম্ভীর্য আর মৃদু হাসি নিয়ে, অটোগ্রাফ দিয়ে চলছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। আর হয়তো তাকে ঘিরে উড়ে চলছে কিছু চেনা প্রজাপতি।

 

তারিক ইকবাল: বার্কলে, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

 

Comments

The Daily Star  | English

Taka to trade more freely by next month

Bangladesh will introduce a crawling peg system by next month to make the exchange rate more flexible and improve the foreign currency reserves, a key prescription from the International Monetary Fund.

3h ago