ব্যালে নাচ যখন স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতিশব্দ

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, 'আমাদের ছোট খুপরিতে ভোর আসে/ ব্যালেরিনার মতো নিপুণ বিন্যাসে…'।

এ অঞ্চলের সংস্কৃতিতে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালীয় রেনেসাঁর সময়ে উদ্ভূত ব্যালে নাচের প্রচার কিংবা পসার তেমন ছিল না কখনোই। তারপরেও সে সময় কবির কলম থেকে নিঃসৃত হয়েছিল পরবর্তীতে বিশ্বসংস্কৃতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা ব্যালে নাচ কিংবা ব্যালেরিনার (ব্যালে শিল্পী) কথকতা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে শামসুর রাহমানের ওই কবিতা প্রকাশের প্রায় ৬ দশক পর খোদ ঢাকার বুকে ব্যালে নাচের আলো ছড়িয়েছেন নওগাঁর এক ব্যালে শিল্পী।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে আলোকচিত্রী জয়িতা তৃষার ক্যামেরায় 'উড়ন্ত' মুবাশশিরা ইরার ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সে সময় ভাস্কর্যের সামনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বেশ কিছু প্ল্যাকার্ড ঝোলানো ছিল। এতে করে অনেকেই ইরার মধ্যে তারুণ্য ও প্রতিবাদের ছোঁয়া দেখতে পান। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সম্পর্ক খুঁজে নেন।

আবার 'পাখির ডানায়' উড়ে চলার মতো ইরার ছবিগুলো কেউ কেউ নারী স্বাধীনতার বার্তা হিসেবেও নিয়েছেন।

যদি ইচ্ছে হয় নামের শামসুর রাহমানের ওই কবিতায় কবি আদিম অরণ্যে চলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেও শহরে থেকে গিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, 'কিন্তু আমি যাইনে যাইনে সেখানে, থাকি শহরে, আমার শহরে।/ঊর্ধ্বশ্বাস ট্রাফিকের ব্যস্ততায় বিজ্ঞাপনের মতো/ঝলমলিয়ে ওঠা হাসি/শিরায় আনে আশ্চর্য শিহরণ…'।

তৃষার নির্দেশনায় তোলা ব্যালেরিনা ইরার ছবিগুলোও তেমন করে শিহরণ তুলে যাচ্ছে নেটাগরিকদের মানসে।

আজ রোববার এই আলোচিত ছবিগুলোর নেপথ্যের কারিগর তৃষা ও এর একমাত্র চরিত্র ইরার সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের। তারা বলছেন, রীতিমতো পরিকল্পনা করেই তারা এই ছবিগুলো তুলেছিলেন। যার মূল ভাবনা ছিল 'স্বাধীনতা ও মুক্তি'।

এ ব্যাপারে বর্তমানে নওগাঁ সরকারি কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইরা বলেন, 'আমি ২০১৭ সাল থেকে নাচ করি। লকডাউনের মধ্যে ইউটিউব দেখে এটা (ব্যালে নাচ) আমার শেখা। প্র্যাকটিসের সময় ছোট ছোট ভিডিও আমি আপলোড করতাম। এগুলো দেখে সাগর দেবনাথ নামের একজন আমাকে জানান, আগ্রহী থাকলে তিনি আমার নাচের কিছু ফটোশ্যুট করতে চান। তখন যমুনা ফিউচার পার্কে আমরা ফটোশ্যুট করি।'

ইরার জানান, যমুনা ফিউচার পার্কে তোলা ছবিগুলো পোস্ট করার পর তা আলোকচিত্রী জয়িতা তৃষার চোখে পড়ে। তখন তিনি একটি কনসেপ্ট ধরে ইরাকে তার সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন।

ইরা বলেন, 'আমাদের প্রথম ফটোশ্যুট ছিল গত বছরের ২ নভেম্বর, ধানমন্ডি লেকে। পরে আমরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে ছবি তোলার পরিকল্পনা করি।'

ঢাকার রাস্তায় এমন ভঙ্গিমায় ছবি মানুষ কীভাবে দেখবে, তা নিয়ে যথেষ্ট উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন ইরা। কিন্তু ছবিগুলো যে এতটা আলোড়ন তৈরি করবে, তা তিনি একেবারেই প্রত্যাশা করেননি বলে জানান তিনি।

ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপচারিতায় ইরার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়েও কথা হয়। তিনি বলেন, 'আমার ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগে পড়া, নাচ নিয়ে গবেষণা করা।'

এ ব্যাপারে ইরার বক্তব্য, 'আমি যেমন অন্য একটা দেশের নাচ আমাদের দেশে আলোচিত করেছি, ঠিক তেমনি আমার দেশের নাচ আমি বাইরের দেশগুলোতে পরিচিত করে তুলতে চাই।

এদিকে আলোচিত ছবিগুলোর আলোকচিত্রী জয়িতা তৃষা একজন ক্যান্সারের রোগী। এখনো তার চিকিৎসা চলছে। শুরুতে রোগের বিষাদ-যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে আসার তাগিদ থেকেই তিনি 'স্বাধীনতা ও মুক্তি' কনসেপ্টে কাজ করার আগ্রহ বোধ করেন বলে জানান।

তৃষা বলেন, 'ইরার কিছু ভালো ছবি দরকার ছিল। কারণ সে একজন নৃত্যশিল্পী। আর আমার বিষয়টা ছিল ভিন্ন কিছু করার, যা বাংলাদেশের মানুষ আগে দেখেনি।'

তৃষা আরও বলেন, 'রাজু ভাস্কর্যের সামনে যেদিন ছবি তোলার কথা ছিল সেদিন সেখানে অনেকগুলো প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ব্যানার রাখা ছিল। সুতরাং আমার স্বাধীনতার ভাবনার সঙ্গে ওই ভাবনাটিও তখন মিলে যায়।'

পরবর্তীতে বাংলাদেশের অন্য কোনো আর্ট ফর্ম ও এর শিল্পীকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছার কথা জানান তৃষা। বলেন, 'হয়তো এমন কোনো পেইন্টার আছেন, যিনি চমকপ্রদ কোনো কাজ করে যাচ্ছেন। আমি ছবিতে তাদের সেই কাজগুলো ধরতে চাই।'

এর বাইরে ভবিষ্যতে ক্যান্সার রোগীদের নিয়েও কাজ করার আগ্রহের কথা জানান তৃষা।

Comments

The Daily Star  | English
remittance earning of Bangladesh

Remittance rises 30% in July

Migrants sent home $2.47 billion in the first month of the current fiscal year

5h ago