জহির রায়হানের শেষ দিনগুলো

জহির রায়হান

বিজয়ের একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর ভারত থেকে দেশে ফেরার পর ২৫ জানুয়ারি প্রেস ক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক জহির রায়হান বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনের নীল নকশা উদঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বহু নথিপত্র এখন তার হাতে। তিনি শিগগির তা উদঘাটন করবেন।

২৬ জানুয়ারি ছিল ঈদুল আযহা। জহির রায়হান এদিন জানতে পারেন শিগগির মিরপুরে সেনা অভিযান হবে। ঈদের দিন বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে ৩ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তরে এসেছিলেন জহির রায়হান। এরপর তিনি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি সেনা অভিযানে থাকার ইচ্ছার কথা জানান। স্বাধীনতার পর থেকেই লোকমুখে শোনা যাচ্ছিল মিরপুরে সশস্ত্র বিহারীরা শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, ফয়জুল মহিউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে আটকে রেখেছে।

জহির রায়হানকে জেনারেল ওসমানী বললেন, তিন দিন পর সেনা অভিযান হবে। তাকে অভিযানের খবর দেওয়া হবে। ২৯ জানুয়ারি মিরপুর টেকনিক্যালে আসেন জহির রায়হান। তাকে পরদিন সকালে আসতে বলা হয়। ৩০ তারিখ থেকেই শুরু হবে সেনা অভিযান। ২৯ জানুয়ারি রাতে মিরপুরের অতিরিক্ত এসপি জিয়াউল হক লোদীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয় জহির রায়হানের।

কী হয়েছিল ৩০ জানুয়ারিতে?

৩০ জানুয়ারি রোববার খুব সকালে কায়েতটুলীর বাসায় একটি অজানা নাম্বার থেকে ফোন আসে জহির রায়হানের কাছে। ফোনের অপর পাশ থেকে বলা হয়, 'আপনার বড়দা (শহীদুল্লা কায়সার) মিরপুর ১২ নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন।'

এই ফোন কে করেছিলেন তা জানা গিয়েছিল বহু পরে।

পাওয়ার পর সকালে দুটি ব্যক্তিগত গাড়িতে জহির রায়হান, তার ছোট ভাই জাকারিয়া হাবিব, চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবির, শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সারের ভাই বাবলু, জহির রায়হানের দ্বিতীয় স্ত্রী সুচন্দার ভাইসহ ২ নম্বর সেক্টরের বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মিরপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। একটি গাড়ি চালাচ্ছিলেন জহির রায়হান, অন্যটি জাকারিয়া হাবিব। মিরপুর টেকনিক্যালের পাশ দিয়ে মিরপুর ১ নম্বরের দিকে ঘুরে গাড়ি দুটি সামান্য এগোতেই গাবতলির দিক থেকে গুলি চালাতে শুরু করে বিহারীরা। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে মিরপুর ২ নম্বরে পৌঁছান তারা।

যেখানে শহীদ হয়েছেন জহির রায়হান

জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান পিতার অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে লিখেছেন অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন 'পিতার অস্থির সন্ধানে'। যেখানে তিনি বলেছেন, 'সেখানে উপস্থিত ভারতীয় ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অফিসারেরা সিভিলিয়ান দেখে খুবই বিরক্ত হন। বেসামরিক লোকদের ওই এলাকায় ঢোকার অনুমতি ছিল না। সবাইকে চলে যেতে বলা হলো। শেষ পর্যন্ত জহির রায়হান একা থেকে যাওয়ার অনুমতি পান। শাহরিয়ার কবির সহ বাকি সবাই ফিরে আসেন। জহির রায়হানের গাড়িটি রেখে আসা হয়। ওই গাড়িটি একদিন পর রহস্যজনকভাবে পাওয়া যায় রমনা পার্কের সামনে।

মিরপুরে চালানো সেনা অভিযানে একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি ছিলেন জহির রায়হান। জহির রায়হানকে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন ১২ নম্বর প্লাটুন কমান্ডার মোখলেছুর রহমান। ৩০ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত তিনি জহির রায়হানকে চিনতেন না।

জহির রায়হান আসার পর ১২ নম্বর পানির ট্যাংকের সামনে মোখলেছুর রহমানের সঙ্গে জহির রায়হানের পরিচয় করিয়ে দেন অভিযানের কমান্ডার কর্নেল মইনুল হোসেন চৌধুরী। কর্নেল মইনুল এ সময় জহির রায়হানের সঙ্গে দুজন সেনাসদস্যকে রাখার কথা বলেছিলেন। মোখলেছুর রহমান এরপর সিপাহী আকরাম এবং সিপাহী আমির হোসেনকে তার সঙ্গে থাকতে বলেন। মোখলেসুর রহমান এরপর তার বাহিনী নিয়ে চলে যান পূর্ব বিলের দিকে।

এই সিপাহী আমির হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায় দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত জুলফিকার আলী মানিকের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। সেখানে জুলফিকার আলী মানিক লিখেছেন, 'জহির রায়হানকে এই সৈনিক (আমির হোসেন) নামে চিনতেন না। তবে তাদের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা (মোখলেসুর রহমান) ঘটনাস্থলে জহির রায়হানকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একজন সাংবাদিক হিসেবে। সেদিন জহির রায়হানের অবস্থান থেকে কিছুটা দূরে ছিল তার অবস্থান। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল ওই সাংবাদিক সহ অন্যদের পাহারায় থাকা। ইউনিফর্ম পরিহিত সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বাইরে একমাত্র সাংবাদিক জহির রায়হানই ছিলেন সাদা পোশাকে। আমির হোসেন ঘটনাস্থলে প্রথম তাকে দেখেন সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে........।'

আমির হোসেন সেদিনকার স্মৃতি সম্পর্কে বলেন, 'সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রথম সাংবাদিক সাহেবকে দেখি। পানির ট্যাংকের পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পুলিশের দুজন অফিসারের সঙ্গে তিনি কোথা বলছিলেন। তাদের পাশে 'শ খানেক পুলিশ সদস্য ছিল। আনুমানিক ১১টায় ঢং ঢং করে কয়েকটা পাগলা ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে পাই। এর পরপরই দক্ষিণ দিক থেকে গুলির শব্দ শুনি। সঙ্গে সঙ্গে আমার বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি পুলিশের অনেক সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। সেখানেই একটি ইটের স্তূপের পেছনে আমি অবস্থান নিই। তাকিয়ে দেখি পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিক সাহেবও যেখানে দাঁড়িয়ে কোথা বলছিলেন তার কাছেই পানির ট্যাংকের দেয়ালের পাশে তার দেহ পড়ে আছে। মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ার ভঙ্গিতে দেয়ালের ওপর পড়েছিলেন তিনি। সাংবাদিক সাহেবের জামার বড়ো অংশ জুড়ে রক্তের দাগ দেখতে পাই। এর আগেই উত্তর দিক থেকেও বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হয়।'

গোলাগুলি হতে পারে এমন কোনো ধারণাই ছিল না আমির হোসেনের। বিহারীদের এই গোলাগুলির নেতৃত্ব দিয়েছিল মিরপুরের কসাই আখতার গুন্ডা। আশপাশে থাকা টিনের ঝুপড়ির ফাঁক দিয়ে গুলি চালিয়েছিল বিহারীরা।

নূরী মসজিদের ভিতরে শহীদ স্মরণে কৃষ্ণ স্তম্ভ। ছবি: আবদুস সালাম

বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ এবং সবাইকে মাটিতে পড়তে দেখে আমির হোসেন বুঝতে পারেন পরিস্থিতি ভয়াবহ। তাই তিনি কিছুটা আড়ালে সরে হাতে থাকা এলএমজি তাক করেছিলেন। গুলিতে পুলিশ সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর গুলি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শতাধিক বিহারী নানান দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসতে থাকে। তারা উর্দুতে গালিগালাজ করছিল এবং কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে চিৎকার করছিল। যেসব পুলিশ সদস্য আহত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল তারা তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো শুরু করে। এসময় পড়ে থাকা সাংবাদিককে ৬/৭ জন বিহারী হাত ঘাড় ও কোমর ধরে টেনে নিয়ে যায় পানির ট্যাংকের পশ্চিম দিকে। আমির হোসেন কোনক্রমে সেদিন ওখান থেকে পালিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন।

একই দিন জহির রায়হানের সঙ্গে নিখোঁজ হয়েছিলেন মিরপুরের অ্যাডিশনাল এসপি জিয়াউল হক লোদী।

১২ নং প্লাটুনের কমান্ডার মোখলেসুর রহমান তার স্মৃতিতে বলেছিলেন, 'সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিহারীরা পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে একযোগে গুলিবর্ষণ শুরু করে। বিহারীদের আক্রমণের খবর শুনেই দ্রুত দল নিয়ে ১২ নম্বর কালাপানি ট্যাংকের সামনে আসেন তিনি। তখন তিনি পানির ট্যাংকের সামনে জহির রায়হানের রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান। এটি ছিল সামনের দেয়ালে। দেয়ালের উল্টো দিকে ছিল মিরপুরের এডিশনাল এসপি জিয়াউল হক খান লোদী, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর শতাধিক অফিসার ও সেনাদের লাশ। এরপর তারা দেখেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বিহারীরা তাদের দেখতে পেয়ে আবার গুলিবর্ষণ শুরু করে।

এরপর আর জহির রায়হানের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমির হোসেন যেহেতু বলেছেন বিহারীরা তাকে পানির ট্যাংকের পশ্চিম দিকে টেনে নিয়ে গেছে সুতরাং অনেকে মনে করেন জহির রায়হানের লাশ মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের নূরী মসজিদ সংলগ্ন কুয়াতেই ফেলে দেওয়া হয়। এই পরিত্যক্ত কুয়ার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল দীর্ঘ ২৮ বছর পরে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে। ২৭ জুলাইয়ের ঘটনা সেটি।

১২ নম্বর সেকশনের নূরী মসজিদ সংলগ্ন ফাঁকা জায়গায় চলছিলো মসজিদ সম্প্রসারণের কাজ। নতুন পিলার তৈরি করার সময় মাটির নিচে একটি পরিত্যক্ত কুয়ার সন্ধান পান নির্মাণ শ্রমিকেরা। কুয়ার মুখটি ছিল কংক্রিটের স্লাব দিয়ে ঢাকা। নির্মাণ শ্রমিকেরা স্লাবের অংশবিশেষ ভেঙে তুলতেই কুয়ার মুখ থেকে তিনটি মাথার খুলি এবং বেশ কিছু হাড়গোড় দেখতে পান। পরদিন খনন করতে গিয়ে আরও একটি মাথার খুলি এবং কিছু হাড়গোড় পাওয়া যায়। মসজিদ কমিটি বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করলেও তা ছড়িয়ে পড়ে। একাত্তরের স্মৃতি পরিষদ নামের একটি সংগঠন সেখান থেকে মাথার খুলি ও হাড়গুলো সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দেয়। এর তিনদিন পরে ৩১ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত কুয়াটিতে খনন কাজ শুরু করে। ১২ আগস্ট মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। ৩১ জুলাই থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খননে স্বাধীনতার ২৮ বছর পরে আবিষ্কৃত হয় এক অজানা বধ্যভূমি, মুসলিম বাজার বধ্যভূমি। এই কুয়াতে পাওয়া গিয়েছিল ৫টি মাথার খুলি, ৬০০র বেশি হাড়। কিন্তু এই বধ্যভূমির কোনো চিহ্নমাত্রও নেই। মসজিদের ভেতরে থাকা সাদা রঙের টাইলসের পিলারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কালো রঙের টাইলসের পিলার জানান দেয় এর অস্তিত্ব। মসজিদের দক্ষিণ পশ্চিম কোণের পিলারটির জায়গাতেই ছিল পরিত্যক্ত কুয়াটি।

জহির রায়হানকে যে গুলি করে হত্যা করে বিহারীরা লাশ গুম করেছিল তা প্রমাণিত। জহির রায়হান যে বিহারীদের হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তা সত্য। তবুও দিনের পর দিন নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে। বিভ্রান্ত করা হয়েছে মানুষকে।

৩০ জানুয়ারি সকালে জহির রায়হানকে ফোন করেছিল আসগর আলী মাস্তানা নামের এক বিহারী। তিনি ঢাকাই চলচ্চিত্রে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেছিল। মিরপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালি হত্যার অন্যতম কুশীলব ছিল এই মাস্তানা।

তবে জহির রায়হানের লাশের সর্বশেষ ঠিকানা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। হয়তো মুসলিম বাজার বধ্যভূমিতে তার লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে শতাধিক লাশ কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়েছিল। হয়তো অন্য কোন ডোবা বা জলাশয়ে ফেলা হয়েছিল। হতে পারে, জহির রায়হান যেখানে গুলিবিদ্ধ হন সেই মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে পানির ট্যাঙ্কির কাছেই গড়ে উঠা মাদ্রাসা দারুর রাশাদের পেছনের কুয়া ও ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়েছে তার মরদেহ। পরদিন এই রক্তের উপর দাঁড়িয়েই মুক্ত হয়েছে মিরপুর।

সূত্র-

নিখোঁজ নন গুলিতে নিহত হয়েছেন জহির রায়হান/জুলফিকার আলী মানিক; দৈনিক ভোরের কাগজ, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯

মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি/মিরাজ মিজু

যেখানে শহীদ হয়েছিলেন জহির রায়হান/কমল জোহা খান: দৈনিক প্রথম আলো

পিতার অস্থির সন্ধানে/ অনল রায়হান: সাপ্তাহিক ২০০০

 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Remittance-rich Sylhet ranks poorest in new index

Long seen as the “London of Bangladesh” for its foreign earnings and opulent villas, Sylhet has been dealt a sobering blow. The country’s first Multidimensional Poverty Index (MPI) has revealed that the division is, in fact, the poorest in Bangladesh when measured by access to education, healthc

3h ago