তোমাকে মনে রেখে দেব, আব্বা!

হাসান আজিজুল হক (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ - ১৫ নভেম্বর ২০২১)

হাসান আজিজুল হকের ছেলে ড. ইমতিয়াজ হাসান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। হাসান আজিজুল হক ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। গত বছর ১৫ নভেম্বর বিহাসের নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি ৮২ বছর বয়সে মারা যান। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।

বাবার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। ছেলে হিসেবে তাই হবার কথা। প্রতি বছর আমরা পারিবারিকভাবে আব্বার জন্মদিন পালন করতাম। ১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় আব্বাকে নিয়ে সবাই মিলে খুব আনন্দ করে একটা কেক কাটতাম। পরের দিনের পুরো সময়টা রেখে দিতাম আব্বার পাঠক, শুভাকাঙ্খীদের জন্যে।

করোনা আসার পর থেকে সেটায় একটু ভাটা পড়েছিল। কিন্তু রাত ১২টায় কেক কাটার রেওয়াজটা ছিল। সর্বশেষ জন্মদিনের একটা ছবি আমরা বাঁধিয়ে রেখেছি। ছবিটায় আমার স্ত্রী-ছেলেদের সঙ্গে বাবা রয়েছেন হাসিমুখে। আমার ছেলেরাও দাদাকে জড়িয়ে আছে। আজ সেই স্মৃতিটা খুব তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। 

বাবাকে হারানোর দিন দশেক পর এই কয়টি লাইন লিখতে পেরেছিলাম -  

আব্বা, জানোই তো, তোমাকে নিয়ে লেখা আমার জন্য কী ভীষণরকমের কঠিন! সে শুধু তোমার বিশালতা আর ব্যাপ্তির কারণে নয়, তোমার সরল-স্নিগ্ধ-সমৃদ্ধ জীবনের বর্ণনা কিভাবে দেব, কিভাবে তোমার সাথে কাটানো এই জীবনটুকুর কথা তুলে ধরব, সেটা ভেবে দিশেহারা লাগে। শেষ কয়েকটা মাস আমরা সবাই একসাথে কতোই না চেষ্টা করলাম, তবু যেতে দিতেই হলো তোমাকে। না খাওয়ার জন্য কতো বকাবকি, অভিমান করলাম–ক্ষমা চেয়ে নেওয়া হলো না সেজন্য। অবশ্য তুমি আমার উপর রাগ করেছ, জীবনে এমন ঘটেছে কয় বার? সেই ছোটবেলায় 'বাঘেরা বনের মধ্যে দৌড়াচ্ছে' ট্রান্সলেট করতে পারিনি–তখন একবার রেগেছিলে। তারপর তো আর সেভাবে মনেই পড়ছে না!

ছোট্ট আমাকে সকালে একটা রুটি খাইয়ে দিতে আর মাঝে মাঝে চুল আঁচড়ে দিতে জোরে জোরে–এই ছিল তোমার আদরের দৌড়। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে থাকতে আর আমার কাজ ছিল তোমার উপর উঠে কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত মাড়িয়ে যাওয়া, খুব আরাম পেতে, ঘুমিয়েই পড়তে! সবসময় কত নিশ্চিন্ত থাকতে আমাদের নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে কখনো চাপ দাওনি, ক্লাসে রোল যতই হোক, বাংলা-ইংরেজি দুটোই দ্রুতগতিতে নির্ভুলভাবে লিখতে পারি–এই ছিল তোমার খুশির কারণ! খাওয়ার টেবিলে, বৃষ্টি-দুপুরে, লেপের নিচে–হঠাৎ হঠাৎ তোমার গল্পের জাদুতে মোহময় হয়ে উঠত আমার ছেলেবেলা।

সারাদিন বাইরে থাকতে, সমস্ত সন্ধ্যাও। তোমার বন্ধু, সহকর্মী আর ছাত্রদের আমি হিংসাই করতাম একটু, তারাই তো জান-প্রাণ ছিল তোমার। ধীরে ধীরে বুঝলাম–ভালোবাসা দেওয়া আর আলো ছড়ানো তোমার কাজ। ওটা করতেই সাদা পাঞ্জাবি পরে সাইকেলে চড়ে হাসিমুখে রওনা দাও তুমি, ফিরে এসেও গভীর রাত পর্যন্ত বই পড়ে আর কলম চালিয়ে সেই কাজটাই আবার শুরু কর। যতটা আমার বাবা, ততটাই তুমি 'হাসান আজিজুল হক'। আস্তে আস্তে মানুষের কাছেই দিয়ে দিলাম তোমাকে, এমনই অভ্যাস হয়ে গেলো–তোমার কফিনও কাঁধে নিতে দিলাম মানুষকেই। তারাও যে ভালবাসত তোমায়, আমার মতো করেই। তবে মাটির বিছানায় তোমাকে আমি নিজের হাতে নামিয়েছি আব্বা, যেন ব্যথা না পাও। তারপর শেষবারের মতো দেখে নিয়েছি তোমার প্রশান্ত মুখটি, পশ্চিমে ফিরিয়ে দেওয়ার আগে।   

মনে আছে তোমার, উঠতি-বয়সী আমাকে সময় দিতে না বলে আম্মার বকা খেতে মাঝে-সাঝে? তখন রাতের খাওয়া শেষে আমাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোতে। কোথা থেকে যেন কামিনী-জুঁই-গন্ধরাজ-হাস্নাহেনার সুগন্ধ ভেসে আসত, আর আমার আব্বাকে আমি পুরোপুরি নিজের করে পেতাম। সেভাবেই চিরকাল তোমাকে মনে রেখে দেব, আব্বা!

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh, Pakistan, China launch trilateral cooperation mechanism

A working group will be formed to follow up on and implement the understandings reached during the meeting

54m ago