ঘোড়া-গাধার খোঁড়া গর্তের পানিতে তৃষ্ণা মেটায় বনের প্রাণী

পানির সন্ধানে গর্ত খুঁড়ছে গাধা। ছবি: সংগৃহীত

তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বন্য ঘোড়া ও গাধারা তাদের ধারালো খুর দিয়ে মাটি খুঁড়ে গর্ত তৈরি করে। আর সেই গর্তের পানি খরা মৌসুমে প্রাণরক্ষা করে হাজারো পশু-পাখি এবং উদ্ভিদের। সম্প্রতিকালে দেখা মিলেছে বন্য গাধা আর ঘোড়ার খোড়া গর্ত থেকে বনের প্রাণীদের তৃষ্ণা মেটানোর অভিনব এই পন্থার। 

যুক্তরাষ্ট্রের এরিজোনার সোনোরান মরুভূমিতে গবেষকরা দেখেছেন, বন্য গাধা আর ঘোড়া পানির পিপাসা মেটাতে তাদের ধারালো খুরের মাধ্যমে যে কূপ খনন করে সেগুলো খরা মৌসুমে কয়েক হাজার পশু-পাখি এবং উদ্ভিদের প্রাণ রক্ষা করছে। বন্য গাধা আর ঘোড়াগুলো যে শুধু ক্ষতির তা সঠিক নয়, বিপদে বন্ধুর মতো আচরণ করছে। 

বিষয়টি ২০১৪ সালে প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন ডেনমার্কের আরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ এরিক লুন্ডগ্রেন। তিনি এই প্রজাতির জীবন রক্ষার জন্য খনন করা অসংখ্য কূপ দেখে দারুণ কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তৃষ্ণার্ত হাতির জলের গর্তগুলো যেভাবে সাভানার একটি প্রাণিসম্প্রদায়কে রক্ষা করে। সোনোরান মরুভূমির গাধা আর ঘোড়ার তৈরি কূপগুলোও একইভাবে বাস্তুতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।  

ঘোড়া ও গাধার খোঁড়া গর্ত থেকে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে বন্যপ্রাণীরা।

ধারণা সত্যি কি না যাচাই করার জন্য এরিক লুন্ডগ্রেন তার সহকর্মীদের সহায়তায় সোনোরান মরুভূমির স্থানগুলো পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। তারপর ৪টি এলাকা বাছাই করে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গ্রীষ্মকালে খননকৃত কূপ এবং সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানির স্রোতধারার মানচিত্র তৈরি করে বেশ বিস্মিত হন। কারণ খরা হলে পানির অভাব মেটাতে মানুষ যেমন কূপের পানি ব্যবহার করে, তেমনি সোনোরান মরুভূমিতেও গ্রীষ্মকালের শুষ্ক প্রকৃতিতে গাধা ও ঘোড়ার কূপগুলো বন্য প্রাণীকুলের প্রাণ রক্ষা করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে।  

লুন্ডগ্রেনের মতে, সোনোরান মরুভূমিতে তাপমাত্রার বৃদ্ধির সঙ্গে সুপেয় পানির সংকট বেশ প্রকট আকার ধারণ করে। আশেপাশের পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যায়। কিছু কিছু জায়গায় এই কূপগুলোই তখন হয়ে উঠে একমাত্র ভরসাস্থল। কোথাও কোথাও এই কূপগুলো থেকে ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭৪ শতাংশ পানি সরবরাহ করে। অবিশ্বাস্য হলেও, গাধা আর ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে সৃষ্ট কূপগুলো ৬ ফুট পর্যন্ত গভীর হওয়ার সন্ধান পেয়েছেন লুন্ডগ্রেনের সহকর্মীরা। 

উত্তর আমেরিকায় প্রায় ৫০০ বছর আগে বন্য থেকে গাধা ও ঘোড়ার দেখা মেলে। বর্তমানে দেশটির ব্যুরো অফ ল্যান্ড ম্যানেজমেন্টের তথ্য অনুযায়ী সেখানে ৯৫ হাজারের বেশি বন্য গাধা এবং ঘোড়া রয়েছে। তবে সায়েন্স নিউজের প্রতিবেদনে জোনাথান ল্যামবার্ট বলেন, 'প্রকৃত সংখ্যা এর ৩ গুণ বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।' 

তার মতে, 'এই প্রজাতির প্রাণীগুলো দিনের পর দিন গাছপালা পদদলন থেকে শুরু করে খাঁড়ির বিছানা নষ্ট এবং স্থানীয় প্রাণীদের আক্রমণ করে আসছিল। তাই সেখানে বন্য গাধা আর ঘোড়াকে শত্রুসম মনে করা হতো।'

গর্তগুলোতে জন্ম নেয় বিভিন্ন গাছপালা

গবেষকরা সোনোরান এবং মোজাভ মরুভূমির ৫টি স্থানে ক্যামেরা স্থাপন করে দেখতে পান, মরুভূমির ৫৯টি মেরুদণ্ডী প্রজাতির মধ্যে ৫৭ প্রজাতির প্রাণী কূপগুলো থেকে পানি পান করে। তার মধ্যে অতিথি পাখি, বন্য সিংহ এবং কালো ভল্লুকও দেখা গেছে। এ ছাড়া উইলো এবং কটনউডের মতো কিছু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ যা সাধারণত বন্যার পানি থেকে প্রথম পানি সংগ্রহ করে প্রাণের সঞ্চার করে সেগুলোও ভূপৃষ্ঠ থেকে কূপের পানির সংস্পর্শ পেয়ে অঙ্কুরোদগম করছে সেখানে। মরুভূমিতে গ্রীষ্মকালেও এদের বৃদ্ধি ২ মিটার পর্যন্ত হতে দেখা গেছে। এছাড়া পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, কূপের পানি বিশুদ্ধ এবং সুপেয় হওয়ায় এর চারপাশে প্রাণীদের সমাগম অন্যান্য স্থান হতে প্রায় ৬৪ শতাংশ বেশি।  

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লুন্ডগ্রেন বলেছেন, 'এ অঞ্চলের গাধা এবং ঘোড়ার কূপগুলো উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ। নিজেদের পানির অভাব মেটানোর পাশাপাশি এরা বাস্তুতন্ত্রের অসামান্য উপকার করছে। এদেরকে ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার বললেও খুব একটা ভুল হবে না।'

লারামির ওয়াইমিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ জেফ্রি বেক বলেছেন, 'যদিও এই গবেষণায় কূপগুলোর সুবিধাগুলো স্পষ্ট, তবুও বন্য গাধা এবং ঘোড়াগুলো বাস্তুতন্ত্রের জন্য কতটা উপকারী তা জানার জন্য আরও সময় প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, বিশ্বের শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে এই প্রাণীগুলোর হিংস্রতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। ওয়াইমিং এর লাল মরুভূমিতেও দেখা গেছে বন্য ঘোড়াগুলো কীভাবে নিরীহ প্রাণীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই এরা ঠিক কতটা উপকারী সে সম্পর্কে আমি এখনো নিশ্চিত নই। হতে পারে, সোনোরান মরুভূমিতে কূপগুলোয় ভূপৃষ্ঠ হতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সরবরাহ পাওয়া যায় কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলে তা নাও হতে পারে।'

তবে গবেষকরা আশা করছেন, এই গবেষণার মাধ্যমে বন্য গাধা ও ঘোড়ার বাস্তুতন্ত্রের জন্য কেবল ক্ষতিকর এই ধারণা থেকে বের হওয়া যাবে। প্রকৃতিকে শুদ্ধ করার নাম করে যেভাবে মানুষ হত্যার রীতি চলে আসছে, হতে পারে তার সংস্পর্শ এই প্রজাতির প্রাণীর ওপরও পড়বে। কেন না এরাও যে প্রকৃতিরই অংশ। আর এই ধ্বংস করার অপ্রত্যাশিত ও দুর্ভাগ্যজনক প্রক্রিয়া একসময় পুরো বাস্তুতন্ত্রকে নির্মূল করে ফেলতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সিডনির প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ আরিয়ান ওয়ালাচ।
 

Comments

The Daily Star  | English

Rampal fouling 2 Sundarbans rivers

The Rampal power plant began operation in late 2022 without an effluent treatment plant and has since been discharging untreated waste into the Pasur and Maidara rivers next to the Sundarbans.

4h ago