সম্পদের ‘চেহারা’ একাল ও সেকাল

অর্থ-সম্পদের চেহারাকে না চিনলে সম্পদকে ধরে রাখা যায় না। ভারতের বৈদিক যুগে যার যত বেশি গরু ছিল তাকেই সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী মনে করা হতো। সে সময়ে টাকা নয়, গরুই ছিল বিনিময় মাধ্যম। এর গুরুত্ব এতো বেশি ছিল যে তা দেবত্বে পর্যন্ত রূপ নেয়।

পরবর্তীতে সম্পদের বিনিময় মাধ্যম হয়ে ওঠে ধাতব মুদ্রা—তামা, রুপা, স্বর্ণ। বাংলায় মৌর্য যুগে ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ বিনিময় মাধ্যম, কুষাণ যুগে বাংলায় প্রচুর স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে গুপ্ত যুগ, সুলতানি ও মোগল যুগ পর্যন্ত বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয় স্বর্ণমুদ্রার। পাল ও সেন আমলে কড়ি হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ বিনিময় মাধ্যম।

বিনিময় মাধ্যম হিসেবে গরুর সে আমল শেষ হয়েছে। শেষ হয়েছে ধাতব মুদ্রার যুগেরও। মুদ্রার নামের ও পরিবর্তন ঘটেছে। কাহান, কার্ষাপণ, কাকিণী, ভদ্রি, কড়ি, টংক্যা, আনার নাম পরিবর্তন হয়ে এখন টাকা ও পয়সা শব্দ দিয়ে অর্থকে বুঝি। হাল আমলে প্রযুক্তির এই যুগে এখন অর্থকে বিটকয়েন কিংবা ক্রিপটোকারেন্সিতে রূপান্তর হতে দেখি। ঠিক তেমনি ৩০০ বছর আগে যার যত বেশি জমি ছিল তিনি তত সম্পদশালী ও জমিদার ছিলেন। পরবর্তীতে যার যত বেশি ফ্যাক্টরি ও প্রোডাকশন তিনি তত বেশি ধনী ছিলেন। বর্তমানে যারা তথ্যপ্রযুক্তি তৈরি ও এর নিয়ন্ত্রণ নখদর্পণে রেখেছেন তারাই সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী।

আসহাবে কাহাফের গল্পের মতো পুরনো অনেক অর্থই বাজারে যেমন সময়ের পরিক্রমায় মূল্যহীন হয়ে যায়, ঠিক সম্পদ সম্পর্কে আমাদের পুরানো ভাবনা থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে টাকার গোলাম হওয়ার প্রচেষ্টায় রাত-দিন, গোটাজীবন ব্যস্ত থাকলেও দিন শেষে শূন্য হাতে, পরিবার পরিজনকে অভাবগ্রস্ত ও বিস্বাদগ্রস্ত রেখে একরাশ হতাশা নিয়ে এই জীবনটা পার করতে হয়।

জমি-জমা, বাড়ি-গাড়ি এগুলো আমাদের জীবনে ক্ষুদ্র সম্পদ। বরং এর চেয়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও এর নিয়ামককে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। যে কারণে টাকার লোভে বাবার মৃত্যুর দাফন পর্যন্ত হতে দেয় না সন্তান। আমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হচ্ছে 'সময়' ও নিয়মিত 'শেখা'। এ ছাড়াও শারীরিক সুস্থতা, যৌবন, সন্তান, পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, নিজেদের নিরাপত্তা এগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পদ অর্জন ও তা দীর্ঘ সময় ধরে অটুট রাখার সম্পর্ক রয়েছে। এটি বুঝতে না পারার কারণে এগুলো কীভাবে টেকসই সম্পদ গড়তে ভূমিকা রাখে তা ধরতে না পারার কারণে সাময়িক সময়ের জন্য আমরা বিত্তশালী হলেও সে সম্পদ ও সম্পত্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিংবা এই সম্পদ অর্জনে যখন অনৈতিক পথ অবলম্বন করি তা নিজের জন্য সুসময়ের চেয়ে দুঃসময় বয়ে নিয়ে আসে। আর এই বোঝাপড়ার সীমাবদ্ধতার কারণে দ্রুত জিততে চাওয়ার মানসিকতায় সহযোগিতার চেয়ে প্রত্যেকে পরস্পরকে প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেই।

আমাদের জীবনে সবচেয়ে দামি সম্পদ 'সময়'। মানুষের সময়টা সীমাবদ্ধ। একজন ধনী ব্যক্তি প্রতিদিন যে সময় পেয়ে থাকেন একজন গরীবও একই সময় পান। কারও সাধ্য নেই অর্থসম্পদ দিয়ে বেশি সময় কিনে নেওয়ার। কিংবা গতকালের নষ্ট হওয়া সময়কে কেউ চাইলেই আর ফেরাতে পারি না। তাই সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি মুহূর্তকে ভালো কাজে লাগানোর মধ্য দিয়ে আমরা দীর্ঘস্থায়ী সম্পদ গড়তে পারি।

করোনাকালে কেউ অবসর পেয়ে অলস ও হতাশায় কাটিয়েছেন। কেউ আবার সময়কে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, মানুষ তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নতুন নতুন সমস্যাকে মোকাবিলা করে অগ্রসর হয়েছে। পাথর যুগে যেমন হাতিয়ার হিসেবে চপার, চপিং, হ্যান্ডএক্স দিয়ে সমস্যার সমাধান করেছে। সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে পরবর্তীতে মৃৎপাত্র, চাকার আবিষ্কার, তামা ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ারের মাধ্যমে সমস্যার মোকাবিলা করেছেন। পরবর্তীতে লোহার হাতিয়ার তৈরির মধ্য দিয়ে কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। নিউলেথিক পরবর্তী সময়কালে আমরা দেখি নগরায়ন, মিশরীয়, সুমেরিয়, ব্যাবিলনীয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ, এর পরবর্তী সময়ে শিল্পবিপ্লব। সবকিছুতে আমাদের একটি বিষয় শিক্ষা দেয়, যে ব্যক্তি বা যে জাতি সমসাময়িক সমস্যার সমাধান করছেন তারাই জাতির বা বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে।

সময়ের পরবর্তীতে 'জ্ঞান' হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে দামি সম্পদ। বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা সম্পদের অন্যতম নিয়ামক। যার সঙ্গে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কিত। গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবের মালিকরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতার জায়গায় নিত্যনতুন ধারণার মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বুদ্ধি আমাদের সম্পদ উৎপাদনে যেমন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে, আবার বুদ্ধি না থাকার কারণে বাবার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পদ সন্তানরা মাটিতে মিশিয়ে দেন। আমাদের সমস্যাগুলোকে আমরা বুদ্ধির আলোকেই সমাধান করে থাকি। তাই ভালো ও যুগোপযোগী শিক্ষা আমাদের সুস্থ মস্তিষ্ক গঠনে ও সুস্থ বুদ্ধি তৈরিতে করণীয় নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।

ব্যক্তি জীবনে 'শারীরিক সুস্থতা' আমাদের সম্পদের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। এর কোনো বিকল্প হতে পারে না। ক্যান্সারসহ জটিল রোগে আক্রান্ত অনেক অর্থকড়ি কামানো ব্যক্তি মাত্রই তা উপলব্ধি করেন। স্বাস্থ্যসম্মত ও সুস্থ জীবনধারা অনুসরণ আমাদের সম্পদ নষ্ট হওয়া থেকে সম্পদকে টেকসই রাখতে অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রাখে। মন ভালো থাকার সঙ্গে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত। মানসিক স্বাস্থ্যে ব্যাঘাত ঘটলে তার প্রভাব অল্প সময়েই শরীরে দেখা যায়। বিত্তশালী মানুষ হলেও আত্মহত্যা থেকে শুরু করে অনেক খারাপ পরিণতির দিকে নিজেকে ঠেলে দেন মানসিক প্রশান্তি তথা মানসিকভাবে সুস্থ না থাকায়। তাই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে পাশ কাটিয়ে একজন ব্যক্তি, সমাজ, দেশ কখনোই সম্পদশালী হয়ে ওঠতে পারে না। হলেও তা খুবই সাময়িক সময়ের জন্য।

'পূর্ণ নিরাপত্তা' সম্পদ রক্ষার অন্যতম নিয়ামক। হামলা-মামলা, ছিনতাই, রাহাজানি, আত্নসম্মানবোধের হানি ঘটতে পারে এমন উদ্বিগ্ন পরিবেশে হাজার ডলার আয় করা মানুষও একটি মুহূর্তের জন্য মানসিকভাবে ভালো থাকতে পারেন না। যত টাকাই থাকুক আদতে তিনি সঙ্কটেই থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের উচ্চবিত্তের একটি অংশ তাদের সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে থাকতে দেশের বাইরে চলে যাওয়া সহজেই আমাদের বিষয়টি উদাহরণসহ বুঝিয়ে দেয়।

যুগোপযোগী নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ হিসেবে সন্তানকে গড়ে তুলতে উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ দেওয়ার মধ্য দিয়ে টেকসই সম্পদ গড়ার কাজটি সম্পন্ন হয়। শুধুমাত্র সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেড তৈরি করার মধ্য দিয়ে আমরা ব্যর্থ হবো, যদি প্রজন্মকে বিনয়, নম্রতা, নৈতিক ও মানবীয় গুণাবলি সম্পন্ন আত্মবিশ্বাসী, স্পষ্টভাষীরূপে গড়ে তুলতে না পারি। পুরো প্রক্রিয়াটি না বোঝার কারণে দৃশ্যমান টাকা আয় করলেও দিন শেষে সে টাকা আমাদের স্বাস্থ্য, সম্মান, সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে না। কখনো সে টাকা ছিনতাই হয়, কিংবা সন্তান নষ্ট করে ফেলে। কখনো আবার যে জায়গা, সম্পদের দখলদারিত্ব নিয়ে ত্রাস, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হই, যে বস্তুগত উপকরণ নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে, সংঘর্ষে লিপ্ত হই, সেই জায়গা ও সম্পদগুলো ৩০-৫০ বছরের মধ্যেই মালিকানায় পরিবর্তন হয়। কখনো তা দৃশ্যমান হয়, কখনো জমিদারদের প্রজন্মদের দিকে তাকালে সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

বস্তুর অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী। একজনের হাত হয়ে আরেকজনের হাতে তা সময়ের ব্যবধানে চলে যায়। আমাদের প্রাণ স্বল্পস্থায়ী, একবার কোনো আত্নীয়, স্বজন, পরিবারের সদস্য চলে গেলে কখনো আর সে ফিরে আসে না। প্রাণের সম্পর্কটা বুঝতে না পারলে আমাদের সম্পদের তথা বস্তুর কাছে হেরে যাবে প্রাণ, মানবিকতা, মনুষ্যত্ব।

বেশি সম্পদ আহরণ, দৃশ্যমান সুবিধা লাভ, বিলাসদ্রব্য, স্বার্থ উদ্ধার, ভোগের সামগ্রী, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপকরণ অর্জনে প্রতিযোগিতায় একজন আরেকজনকে টপকে যাওয়ার প্রচেষ্টা আমাদের সাময়িক সময়ের জন্য জেতালেও একসময় সবাইকে হারিয়ে দিবে। ইতিহাস সে কথাই বলে। বরং পরস্পরের প্রতি মনোযোগী, সেবার মানসিকতা, অল্পতে তুষ্টি আমাদের একটি প্রশান্তির জীবন দিবে। যে জীবনে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম থাকলেও আত্মহত্যা কিংবা অস্থিরতা থাকবে না। গড়ে উঠবে এক মানবিক পৃথিবী।

মুতাসিম বিল্লাহ, শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

13h ago