ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১ হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার

ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ১ হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়নি।
কলা গাছ পুঁতে বাঁশ, কাঠ ও কাগজ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করছে শিক্ষার্থীরা। ছবি: মাসুক হৃদয়/স্টার

ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ১ হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়নি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার না থাকায় ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি পেলেও এর ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা নেওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার অন্তত ৫ লাখ শিক্ষার্থী।

সরকারি তহবিলের অভাব ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনার কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে উঠছে না শহীদ মিনার। শহীদ মিনার না থাকা কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২১ ফেব্রুয়ারি এলে নিজেদের উদ্যোগে কলা গাছ পুঁতে বাঁশ, কাঠ ও কাগজ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়ে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিবরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো ১ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই কোনো শহীদ মিনার। ছবি: মাসুক হৃদয়/স্টার

এ ছাড়া, সরকারি নির্দেশনা থাকলেও জেলার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মাতৃভাষা দিবসের কোনো কর্মসূচী পালন করা হয় না।

জেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের মোট ১৩৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ১ হাজার ৮টি প্রতিষ্ঠানে কোনো শহীদ মিনার নেই। জেলার মোট ১ হাজার ১০৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৯২৫টিতে কোনো শহীদ মিনার নেই। মাত্র ১৮২টিতে স্থায়ী শহীদ মিনার আছে। এ ছাড়া জেলার ২৪৫টি উচ্চ বিদ্যালয়ের মধ্যে ৮৩টিতে কোনো শহীদ মিনার নেই।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলায় ১২৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪৯ হাজার ৭৭১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে এর মধ্যে মাত্র ২৩টি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে। বিজয়নগর উপজেলায় ১০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৭ হাজার ১৯৬ জন। এর মধ্যে মাত্র ৫টি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে। সরাইল উপজেলার ১২৬টি বিদ্যালয়ে রয়েছে ৪৫ হাজার ৫১০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে মাত্র ১০টি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে।

নাসিরনগর উপজেলার ১২৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪২ হাজার ৭৯ জন। এই উপজেলায় মাত্র ১৫টি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার আছে। আশুগঞ্জ উপজেলার ৪৯টি বিদ্যালয়ে ১৭ হাজার ৪৪৮ জন শিক্ষার্থী, শহীদ মিনার রয়েছে মাত্র ৭টি। আখাউড়া উপজেলার ৫৪টি বিদ্যালয়ে ১৪ হাজার ৩৭৩ জন শিক্ষার্থী, শহীদ মিনার রয়েছে ৪১টি প্রতিষ্ঠানে।

কসবা উপজেলায় ১৬৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪২ হাজার ৫৩৫ জন। অথচ শহীদ মিনার রয়েছে মাত্র ২৪টি প্রতিষ্ঠান। নবীনগর উপজেলার ২২১টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছে ৬৭ হাজার ৪৮১ জন, শহীদ মিনার রয়েছে মাত্র ৩৬টিতে। বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ১৩৯টি বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৩৮ হাজার ১৩৫ জন। শহীদ মিনার রয়েছে মাত্র ২১টিতে।

জেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে শহীদ মিনার নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ইতোমধ্যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

তবে মূলত সরকারি বরাদ্দের অভাবে শহীদ মিনার নির্মাণে সংশ্লিষ্টরা আগ্রহী হয় না বলে জানালেন তিনি।

এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি ও কবি জয়দুল হোসেন বলেন, 'ভাষা আন্দোলন শুরুর আগে ১৯৪৮ সালের ২৪ জানুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম দাবি উত্থাপনকারী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাড়ি আরও অনেক ভাষা সৈনিকের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। অথচ এটা দুঃখজনক যে, জেলার এত বেশি সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'শহীদ মিনার না থাকার কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি গ্রামের অধিকাংশ স্কুল বন্ধ থাকে। ফলস্বরূপ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়া একটি মহান দিবস নীরবে কেটে যায়।'

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার হারুন-উর-রশিদ বলেন, 'প্রতি বছর জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জাতীয় দিবসগুলো গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়। এসব অনুষ্ঠানে শহর এলাকার অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। দূরত্বের কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীরা এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারে না। ফলে তারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে জেলার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা প্রয়োজন।'

Comments

The Daily Star  | English
Workers rights vs corporate profits

How some actors gambled with workers’ rights to save corporate profits

The CSDDD is the result of years of campaigning by a large coalition of civil society groups who managed to shift the narrative around corporate abuse.

10h ago