ভোটারদের উদাসীনতা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কালপর্ব

সদ্য বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে অনুষ্ঠিত প্রায় সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এর আগের ইসির অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনগুলোর তুলনায় ভোটার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
সেইসঙ্গে বেড়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া প্রার্থীর সংখ্যা।
বিশেষজ্ঞরা ব্যাপারটিকে দেখছেন গণতন্ত্রের জন্য একটি অশনি সংকেত হিসেবে। তারা বলছেন, এটি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা কমে আসার প্রতিফলন।
বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় ভোটের হার কমেছে এবং রেকর্ড সংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের আর আস্থা নেই'।
তার কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বিদায়ী ইসির নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, 'জনগণের মনে নির্বাচনের প্রতি ঘৃণা দেখা দিয়েছে, যা গণতন্ত্রকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছে'।
ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে, বেশ কয়েকজন ভোটারও ভোট দেওয়ার বিষয়ে তাদের উদাসীনতার কথা বলেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজন ভোটার প্রশ্ন রাখেন, 'আমরা প্রতিবারই ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ী হতে দেখছি। তাহলে আমার ভোট দিয়ে লাভ কী?'
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার মোট ১৫ জন ভোটারের সঙ্গে কথা বলেছে ডেইলি স্টার। যার মধ্যে ৮ জনই বলেছেন যে, তারা তাদের এলাকায় অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দেননি।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসির ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন আগামী ৫ বছরের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশ করার জন্য কাজ করছে সার্চ কমিটি।
ইসির তথ্য অনুসারে নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটদানের হার ২০১৪ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে হওয়া উপজেলা নির্বাচনের তুলনায় ২১ শতাংশ কমেছে।
এ ছাড়া পৌরসভা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। আর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে কমেছে ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
নুরুল হুদা কমিশনের অধীনে সারাদেশে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের ৪ হাজার ৮৫০ জন চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ৪৯২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন একটি ভোটও না পেয়ে। ময়মনসিংহ সিটিতে মেয়র নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটেছে।
ইসি থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্যে ৩ জন বাদে সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাধুবাদ পায়। মেয়াদের শেষ দিকে এসে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনও এমন ব্যতিক্রম ছিল।
কিন্তু অনিয়ম ও সহিংসতার কারণে অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নুরুল হুদা কমিশন সমালোচনার মুখে পড়ে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় অন্তত ১০১ জন নিহত হন। আহত হন কয়েক শতাধিক।
বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল উপজেলা ও ইউপি নির্বাচন বর্জন করে। তাদের ভাষ্য ছিল, নুরুল হুদা কমিশনের অধীনে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্য, নির্বাচন বর্জন করা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য ইসির পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, 'তারা (ইসি) বলেছে যে, কেউ নির্বাচনে অংশ না নিলে তারা কিছুই করতে পারবে না…দায়িত্ব এড়াতে এটি একটি পুরোনো কৌশল'।
নুরুল হুদা কমিশনের অধীনে ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচন, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত পৌরসভা নির্বাচন এবং গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
কমিশনের তথ্য অনুসারে, এবার ইউপি নির্বাচনে গড় ভোট পড়েছে ৭১ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৬ সালে এই হার ছিল ৭৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এদিকে এবার ২৩০টি পৌরসভার নির্বাচনে পড়া ভোটের হার ৬৫ শতাংশ। ২০১৫ সালের উপজেলা নির্বাচনের তুলনায় যা ৯ শতাংশ কম। আর এবার উপজেলা পরিষদে ভোট পড়েছে ৪০ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০১৪ সালে এই হার ছিল ৬১ দশমিক ২৩ শতাংশ।
গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। ঢাকা, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও ভোটের হার কমেছে।
যদিও এ সময়ে রাজশাহী ও বরিশাল সিটিতে ভোটের হার বেড়েছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ বলেন, 'নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে মানের অবনমন ঘটেছে এবং সে কারণে (নির্বাচনে) ভোটারদের অংশগ্রহণও কমেছে'।
তার পর্যবেক্ষণ হলো, ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার সঙ্গে নির্বাচনের অনিয়ম ও সহিংসতা সরাসরি জড়িত। তিনি আরও বলেন, 'নির্বাচন কমিশন এ ২টি (অনিয়ম ও সহিংসতা)। ফলে অনেক ভোটার ইসির ওপর বিশ্বাস হারিয়েছেন'।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে আরেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় ভোটার উপস্থিতি কমে গেছে। এ বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল, 'বিএনপির অনেক একান্ত সমর্থক ভোটদানে বিরত থাকায় নির্বাচন কম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে '।
সহজ সব জয়
ইসির তথ্য অনুসারে, নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশনের আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
এই মেয়াদে ৩৬৯টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ২০৭টি।
২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনের ৫ ধাপে কোনো চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হননি। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৪টিতে।
২০১৫ সালে ৭টি পৌরসভার চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনে যা ৯টিতে দাঁড়ায়।
শারমিন মুরশিদের ভাষ্য, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া প্রায় সব প্রার্থীই ক্ষমতাসীন দলের, যা ইঙ্গিত করে যে, 'এই নির্বাচনে ক্ষমতা ও অর্থ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে'।
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments