জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে রক্ষা করা হয়েছিল ৭ মার্চের ভাষণ

১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল।

সেই সময়ে সচিবালয় ভবনে অবস্থিত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) অফিস থেকে টিনের একটি ট্রাঙ্ক বের করে নিয়ে যাচ্ছিলেন আমজাদ আলী খন্দকার। কেউ দেখে ফেলে এই উৎকণ্ঠা ছিল তার প্রতিক্ষণে।

পাকিস্তানি দখলদার সেনাদের হাত থেকে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল রক্ষার জন্য ডিএফপির এই তরুণ ক্যামেরাম্যান যে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন তা জানতেন মাত্র গুটিকয়েক মানুষ।

টিনের সেই ট্রাঙ্কে তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিও ফুটেজ এবং অডিও টেপ, যা ছিল জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

সচিবালয় ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এবং বাঙালি অফিসার-কর্মচারীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হচ্ছিল। সুতরাং আমজাদ জানতেন যে তিনি ধরা পড়লে আর শেষ রক্ষা নেই।

২ নম্বর গেইট পার হতে সাহায্যের জন্য ফরিদ নামে একজন বাঙালি পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আগেই কথা বলে রেখেছিলেন আমজাদ। তারপরও শেষ মুহূর্তে যদি কিছু হয়ে যায়, এই চিন্তা তাকে অস্থির করে রেখেছিল।

দুপুর ২টার দিকে ট্রাঙ্কটি একটি 'বেবি ট্যাক্সি'তে তুলে তিনি সচিবালয়ের ২ নম্বর গেইটে পৌঁছান। প্রথম বড় কোনো বাধা পেরোতে ফরিদ সেদিন তাকে সাহায্য করেছিলেন।

ছবি: সংগৃহীত

'খুব ভয়ে ছিলাম। কিন্তু কোনো ভয়ই আমাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত ছিলাম,' সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন আমজাদ।

সচিবালয় থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও ফিল্মগুলোকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার অর্ধেক কাজ ছিল তখনও বাকি।

আমজাদ বলেন, 'সেদিন চকবাজার হয়ে সোয়ারীঘাট পৌঁছাতে আমি কার্জন হলের রাস্তা ধরলাম। নৌকায় বুড়িগঙ্গা পার হয়ে জিঞ্জিরায় পৌঁছাই।'

সেখান থেকে একটা বাসে উঠে তিনি নবাবগঞ্জের বকশনগরে যান। বকশনগর থেকে সাত কিলোমিটার পথ তাকে পায়ে হাঁটতে হয়। এসময় কিছু স্থানীয় লোকের সহযোগিতায় একটি ঘোড়ার ব্যবস্থা হয়, যেটিতে করে তিনি ট্রাঙ্কটি নিয়ে যান।

মুন্সিগঞ্জের জয়পাড়ায় যখন তিনি পৌঁছান তখন সন্ধ্যা।

আমজাদ আলী খন্দকার। ছবি: সংগৃহীত

'আর কোনো উপায় না থাকায় আমি ট্রাঙ্কটি ঘোড়ার ওপরেই রেখেছিলাম। কেউ যদি আমাকে অনুসরণ করে তাহলে মাঠের মধ্যে একটি সরু পথ ধরে দ্রুত কোথাও সরে যাওয়া যাবে।'

'এ কাজে জীবনের ঝুঁকি ছিল। বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট ছিল। ধরা পড়লেই মরতে হতো।'

কয়েকদিন পর যখন জানতে পারলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই এলাকাতেও পৌঁছে গিয়েছে, তিনি কারকোসাই নামে প্রত্যন্ত এক গ্রামে সেই ফিল্ম এবং অডিও টেপের ক্যানগুলো পাঠিয়ে দেন।

পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় সেগুলো ভারতে পাঠানো হয় এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে আবার ফিরিয়ে আনা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের পর আমজাদ আবার ডিএফপিতে কাজ শুরু করেন এবং পরে বাংলাদেশ টেলিভিশন-বিটিভির প্রধান ক্যামেরাম্যান পদে নিযুক্ত হন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর, যখন ষড়যন্ত্রকারীরা ডিএফপি অফিসে হানা দেয়, তখনও তিনি আরেকবার সেই মূল্যবান নথিপত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

কয়েকজন বিশ্বস্ত সহকর্মীর সহায়তায়, তিনি নির্ধারিত ক্যান থেকে ৭ মার্চের ভাষণের ফিল্ম বদলে ফেলেন। ষড়যন্ত্রকারীরা ৭ মার্চের ভাষণ মনে করে সেই ছবির রিল ধ্বংস করে স্বস্তি পায়। আর এভাবেই রক্ষা পায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।

আমজাদ আলী খন্দকারের বয়স এখন ৭৯ বছর। তিনি বলেন, সবার কাছে আবুল খায়ের হিসেবে পরিচিত চলচ্চিত্র বিভাগের তৎকালীন পরিচালক মোহেব্বুর রহমান খায়েরই মূলত ঐতিহাসিক ভাষণের ভিডিও ধারণ থেকে শুরু করে রক্ষা পর্যন্ত সমস্ত পরিকল্পনা করেছিলেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র ও টিভি অভিনেতা আবুল খায়ের ২০০১ সালে মারা যান।

ছবি: সংগৃহীত

তিনিই রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ভিডিও ধারণের জন্য আট সদস্যের একটি দল পাঠিয়েছিলেন। আমজাদ সেই দলেরই একজন ছিলেন।

তারা সেদিন শুটিংয়ের জন্য জার্মান ৩৫এমএম এআরআরআই ক্যামেরা এবং অডিও রেকর্ডিংয়ের জন্য নাগরা (Nagra) অডিও ডিভাইস ব্যবহার করেছিলেন।

সেদিনের কথা মনে করে আমজাদ বলছিলেন, 'বোমা মেরে মঞ্চ উড়িয়ে দেওয়া হতে পারে এমন গুজবও ছিল। আমরা ভীষণ নার্ভাস ছিলাম... কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঠিকমতো রেকর্ড করতে পারবো কি না তাই নিয়েই আমরা বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম।'

'আমরা রেকর্ডিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকায় ভাষণের প্রতি তেমন মনোযোগ দিতে পারিনি তবে বঙ্গবন্ধু যেভাবে তার ভাষণে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাতে আমরা ভীষণভাবে আলোড়িত হয়েছিলাম,' বলেন আমজাদ।

২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যখন বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় তখন কীভাবে এই অমূল্য দলিল রক্ষা করা যায় তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন আবুল খায়ের।

'তিনি (আবুল খায়ের) আমাকে তার বিশ্বস্ত সহকর্মী হিসেবে বিশ্বাস করেছিলেন। যখন তিনি আমাকে এই কাজের কথা বলেন তখন আমি শুধু তাকে বলেছিলাম আমি আমার বাবার সাথে একবার দেখা করতে চাই এবং তার আশীর্বাদ চাই,' ডেইলি স্টারকে এভাবে সেই সময়ের কথা বর্ণনা করেন আমজাদ আলী খন্দকার।

বর্তমানে ডিএফপির মহাপরিচালক এস এম গোলাম কিবরিয়া বলেন, তারা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ রেকর্ড করার পেছনের ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং সেকারণেই একুশে পদকের জন্য আমজাদের নাম প্রস্তাব করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের ভাষণটি ২৬ মার্চ শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের গতি নির্ধারণ করে দিয়েছিল, যা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়।

"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম," স্বাধীনতার দাবিতে এভাবেই গর্জে উঠেছিলেন জাতির পিতা।

জ্যাকব এফ ফিল্ডের 'উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচস দ্যাট ইন্সপায়ারড হিস্ট্রি' বইতে এই ভাষণটিও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা ২৫০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং অনুপ্রেরণাদায়ক যুদ্ধকালীন  ভাষণের এক সংগ্রহ।

বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম বক্তব্যের তালিকায় থাকার যোগ্য হিসেবে ২০১৭ সালে, ইউনেস্কো এই ভাষণটিকে 'মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে' তালিকাভুক্ত করে।

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka set to soar as developers have their way

Bowing to persistent demands from real estate developers, the government has decided to raise the limit on how much floor space can be built on a piece of land -- known as the Floor Area Ratio (FAR) -- in most parts of the capital.

8h ago