জীবনানন্দ সম্পর্কে বিভ্রান্তির অবসানের চেষ্টা করেছি

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে ঐতিহ্য থেকে প্রকাশ হয়েছে গবেষক ও সাংবাদিক আমীন আল রশীদের 'জীবনানন্দের মানচিত্র'। জীবনানন্দ ও তার গবেষণা নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে ঐতিহ্য থেকে প্রকাশ হয়েছে গবেষক ও সাংবাদিক আমীন আল রশীদের 'জীবনানন্দের মানচিত্র'। জীবনানন্দ ও তার গবেষণা নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
 

দ্য ডেইলি স্টার: 'জীবনানন্দের মানচিত্র' বইটির কাজ কতদিন ধরে করেছেন। সে অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?

আমীন আল রশীদ : কাজ শুরু করি ২০০৫ সালে। তখন আমি প্রথম আলোর ঝালকাঠি প্রতিনিধি। অফিসের একটা অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে মনে হলো যে বরিশাল শহরে জীবনানন্দের কী স্মৃতি আছে, সেটি খুঁজে বের করার চেয়ে বরং বাংলাদেশ ও ভারতের যত জায়গায় জীবনানন্দের স্মৃতি আছে, মানে যেসব জায়গায় তিনি ছিলেন, পড়েছেন, পড়িয়েছেন, হেঁটেছেন—সেই সব জায়গা খুঁজে বের করলে কেমন হয়? 
সে ভাবনা থেকে কাজ। কিন্তু আমার তখন সাংবাদিকতায়ও খুব হাত পাকেনি। অভিজ্ঞতা কম। জীবনানন্দ সম্পর্কেও জানি সামান্য। কিন্তু তাঁর প্রতি প্রেমটা ছিল গভীর। ফলে কাজের ব্যাপ্তি, ধরন ও সিরিয়াসনেস না বুঝেই কাজটা শুরু করি। তারপর ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। মাঝখানে দুই তিন বছর কাজটা থেমেও ছিল। ২০১৭ সালের দিকে কাজের গতি আসে। কয়েকবার কলকাতাসহ ভারতের নানা জায়গায় যাই। প্রায় ১৫ বছরের কাজ অবশেষ প্রকাশিত হলো। 

জীবনানন্দ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেছেন। আর্থিক সংকট, না তার মানসিকতা? গবেষণা কী বলে? 

আমীন আল রশীদ : আমার মনে হয় না এখানে আর্থিক সংকট একটা বিষয় ছিল। তবে তিনি কেন বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেছেন তার উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন 'বোধ' কবিতায়। বলেছেন: 'সকল লোকের মাঝে ব'সে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা'। তার মানে নিজের মুদ্রাদোষেই তিনি সকল লোকের মাঝে, সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রের ভেতরে থেকেও একধরনের বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেছেন। নিজেকে আড়ালে রেখেছেন।

জীবনানন্দের কালে কলকাতা শহরকেন্দ্রিক বেশ কিছু সাহিত্যের আড্ডা হতো। কিন্তু সেসব আড্ডা তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। বুদ্ধদেব বসু বলছেন, 'কোনো সাহিত্যিক আড্ডায় আমরা তাঁকে টানতে পারিনি। কল্লোলের, পরিচয়ের, কবিতার আড্ডা তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন। চিঠি লিখতেন সংক্ষেপে, শুধু কাজের কথা। যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, সম্পূর্ণভাবে নিজের মধ্যে গুটানো।...এমন নিভৃত মানুষ আমি আর দেখিনি।'

প্রশ্ন হচ্ছে এর কারণটা কী? যে মুদ্রাদোষের কথা তিনি বলেছেন সেটি কী?

বরিশালের সন্তান হিসেবে রসিকতা করে বলি, জীবনানন্দ 'অরিজিনাল বরিশাইল্লা' নন। কারণ,  বরিশালের মানুষেরা স্বভাবত এবং সাধারণত জোরে বা উচ্চস্বরে কথা বলেন। এর পেছনে বরিশালের জলবায়ু পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, কালচার ইত্যাদির প্রভাব নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেখানে ব্যতিক্রমও আছে। জীবনানন্দ হচ্ছেন সেই ব্যতিক্রম। তিনি বরিশালের মানুষের পরিচিত বা স্বাভাবিক টোনে কথা বলতেন না। তিনি ছিলেন ধীর, স্থির।

বরিশালের মানুষ খুব আড্ডাবাজ প্রকৃতির হয়। জীবনানন্দ তাও ছিলেন না। তার কবিতায় যে একধরনের মায়া, রহস্য, অতিলৌকিকতা দেখা যায়, ব্যক্তিজীবনেও তিনি তাঁর কবিতার মতোই ছিলেন। যাকে সহজে বোঝা যায় না। জীবনানন্দের কবিতার শাব্দিক অর্থ করা যেমন অসম্ভব, তেমনি ব্যক্তি জীবনানন্দকে পাঠ করা আরও কঠিন। তবে এটা ঠিক যে, জীবনানন্দের এই 'আত্মগোপন' গোপনীয় কোনো বিষয় ছিল না। নিজে নিজেকে জানতেন। সমাজ ও রাষ্ট্রকে জানতেন আরও বেশি। তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে বহু বছর এগিয়ে থাকা একজন দার্শনিক। তিনি আজ যা দেখছেন, অন্যেরা তা দেখেছেন অর্ধ শতাব্দী পরে। 

আপনার বইতে দেখা যায় কোনো স্মৃতি অক্ষত নেই আর। আমাদের গুণী ব্যক্তিদের স্মৃতি ধরে রাখার উদাহরণ কম। ঐতিহ্যবোধের অভাবে কী? 

আমীন আল রশীদ : কিছু যে নেই তা নয়। খুব  কম। যেমন আমি প্রথমবার যখন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলে জীবনানন্দের কিছু আছে কি না খুঁজতে যাই, তখন সেখানে যিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন, আমাকে বললেন, জীবনানন্দ দাশ যে এই স্কুলে পড়েছেন, সেটি আমার কাছেই তিনি প্রথম শুনেছেন। আমি তখন যতটা না বিস্মিত, তার চেয়ে বেশি লজ্জিত হয়েছি। আবার ভাবলাম, দোষটা শুধু ওই প্রধান শিক্ষককে দিয়েও লাভ নেই। আমরা জাতিগতভাবেই বিস্মৃতিপ্রবণ অথবা আমরা ততটুকুই স্মৃতি স্মরণে রাখি, যতটুকুতে আমার নিজের লাভ।

১৯৮৪ সালে এই স্কুলের শতবর্ষ স্মরণিকা প্রকাশিত হলো। তাতে এটি যে জীবনানন্দের প্রথম স্কুল, তাঁর বাবাও এই স্কুলের স্বনামধন্য শিক্ষক ছিলেন, সেই কথা পুরো স্মরণিকার কোথাও উল্লেখ নেই। আমি ওই স্মরণিকার সঙ্গে যুক্ত একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী করে সম্ভব? তিনি আমাকে বললেন, 'এটা মিসটেক'। এই হলো আমাদের মিসটেকের ধরন। এটাকে আমি মিসটেক বলি না। বলি নির্লজ্জ বেখেয়াল; কৃতঘ্নতা।

বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে জীবনানন্দের স্মৃতি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ আছে? বরিশাল শহরে যে বাড়িতে তিনি বেড়ে উঠেছেন, ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত যে বাড়িতে ছিলেন, সেই বাড়ির কম্পাউন্ডে তাঁর স্মরণে একটি লাইব্রেরি বানানো হয়েছে। সেখানে ঢুকলে যে কারো মন খারাপ হবে। অধিকাংশ সময় এটা বন্ধই থাকে। পুরো ক্যাম্পাসে জীবনানন্দের আমলের একটা ইটও অবশিষ্ট নেই। রাষ্ট্র তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনবোধ করেনি। কারণ রাষ্ট্রের আরও অনেক 'জরুরি' কাজ আছে। তাছাড়া জীবনানন্দের স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাজনীতিবিদদের কোনো 'পলিটিক্যাল বেনিফিট' নেই।

অথচ পশ্চিমবঙ্গের যেসব কলেজে জীবনানন্দ দুই তিন মাসও পড়িয়েছেন, সেখানে হয় তার একটা ভাস্কর্য আছে, না হয় একটা ম্যুরাল আছে। এমনকি বড়িশা কলেজে যে রেজিস্ট্রি খাতায় তার যোগদানের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে, সেই খাতাটিও আমি খুঁজে পেয়েছি এবং ওই কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ খাতাটি অত্যন্ত যত্নে রেখেছেন। 

সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের সমাজকে কতটা আন্তরিক বলে মনে করেন? যখন বছর বছর অন্য বিভাগের বাজেট বৃদ্ধি পায়। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কমে কেন?

আমীন আল রশীদ : রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পসাহিত্য করতে গেলে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের বাইরে যেতে পারবে না। কী বলবেন তার চেয়ে বেশি আপনার উপরে এলান জারি হয়ে যাবে যে, কী বলবেন না। সুতরাং, আমি মনে করি, সংস্কৃতিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার চাইতে লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কথা বলতে দেয়াটা বেশি জরুরি। আর রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে এমন কিছু নীতিমালা তৈরি করা, যাতে শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়।

জীবনানন্দের মানচিত্র বইটিকে ধারাবিবরণীগ্রন্থ বলব না গবেষণা বলব?

আমীন আল রশীদ : গবেষণা এবং সেই গবেষণার ধারাবিবরণী। আমি এটাকে বলি জার্নালিস্টিক ওয়ার্ক। এখানে ইতিহাস আছে, সাহিত্য আছে। সবচেয়ে বেশি আছে প্রেম। অনেক কবির কবিতাই পড়েছি, পড়ি। কিন্তু জীবনানন্দের মতো কারো প্রেমে তো পড়িনি। পড়িনি বলে তাদের কাউকে আমি খুঁজি না। কিন্তু জীবনানন্দকে খুঁজি।

জীবনানন্দের মানচিত্র শুধু সাহিত্যের গবেষণাই নয়, বরং এর একটি ঐতিহাসিক মূল্যও রয়েছে। যে পাঠকরা এতদিন জীবনানন্দের সাহিত্যকর্মের সঙ্গেই শুধু পরিচিত ছিলেন, তাঁরা এই বইয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি ও লেখক জীবনানন্দ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য যেমন জানতে পারবেন, তেমনি তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর সঙ্গেও পরিচিতি হতে পারবেন। রেফারেন্স ও তথ্যপ্রমাণ ছাড়া একটি লাইনও লিখিনি। জীবনানন্দ সম্পর্কে কিছু মিথ ও বিভ্রান্তিরও অবসান করার চেষ্টা করেছি।

আপনি কবিতা লিখতেন। সাংবাদিকতা করেন। জীবনানন্দের এই কাজের অনুপ্রেরণা কী ছিল?

আমীন আল রশীদ : যারা লেখালেখি করেন, তাদের সবাই জীবনের প্রথম ছড়াও কবিতাই লিখেছেন। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। কবিতার একটা বইও আছে। তবে জীবনানন্দের মানচিত্র লেখার কাজে কবিতাই তো মূল অনুপ্রেরণা ছিল। কারণ কবিতা পড়েই তাঁর প্রেমে পড়ি। পরে এর সঙ্গে সাংবাদিকতা যুক্ত হলে অনুসন্ধানের বিষয়টা প্রধান হয়ে ওঠে। অর্থাৎ একজন  সাংবাদিক বছরের পর বছর ধরে একজন কবির পায়ের চিহ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার অনুসন্ধান কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। সেইসব অনুসন্ধানের আরও কিছু কাজ প্রকাশ করব।  

Comments

The Daily Star  | English

BB finds six types of wrongdoing in export data

The central bank discovered six types of statistical wrongdoing that inflated export data, a development that led to a multibillion-dollar correction.

6h ago