টিকটকের মোহমায়া

টিকটক খুলতেই কোনো এক গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলানো এক মেয়ের ভিডিও যেন লাফিয়ে উঠল আমার মুঠোফোনের পর্দায়। এরপর গানের তালে একটু একটু করে তার চেহারা বদলে গেল, এক পর্যায়ে পুরো মুখটা ভরে উঠল লালচে মাকড়সার জালে। মনে হল এর সঙ্গে তো কথা বলতেই হয়! ভাগ্য ভালো, মিনিট দুয়েক খুঁজেই জেনে ফেললাম মেয়েটার নাম সানজিনা ইসলাম লুপিতা।

টিকটক খুলতেই কোনো এক গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলানো এক মেয়ের ভিডিও যেন লাফিয়ে উঠল আমার মুঠোফোনের পর্দায়। এরপর গানের তালে একটু একটু করে তার চেহারা বদলে গেল, এক পর্যায়ে পুরো মুখটা ভরে উঠল লালচে মাকড়সার জালে। মনে হল এর সঙ্গে তো কথা বলতেই হয়! ভাগ্য ভালো, মিনিট দুয়েক খুঁজেই জেনে ফেললাম মেয়েটার নাম সানজিনা ইসলাম লুপিতা।

সপ্তাহ ঘুরতেই মিলল তার সঙ্গে জুম কলের সুযোগ। টিকটকে তিনি আছেন @isthatgina_ নামে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী লুপিতা বলেন, 'কোয়ারেন্টিনের ভেতর শুরু হয় আমার ফেস আর্টের ঝোঁক। পাবলিক করার কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই অ্যাকাউন্ট চালু করে। চোখের পাতায় ফুলের নকশা আঁকতাম, কখনোবা সাজাতাম নানান ধরণের চরিত্রে। ভিডিও বানানো শুরু করার পর এক বন্ধু উৎসাহ দেয় অ্যাকাউন্টটি পাবলিক করতে।;

মূল লক্ষ্য ইন্সটাগ্রাম জানিয়ে লুপিতা বলেন, 'বাংলাদেশের টিকটক বিদেশের মতো নয়। এখানে পিআর পাওয়া বা আয় করা যায় না। আমার লক্ষ্য এখান থেকে দর্শক জড়ো করা, যারা আমার চেহারা চিনবে। এরপর এক পর্যায়ে এটা ইন্সটাগ্রামে সাহায্য করবে।'

অ্যাপে তিক্ততার সম্মুখীন হয়েছেন কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'আমি এসব থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকি। কেবল ভিডিও দেই টিকটকে। সব মন্তব্যের জবাব দেই না। একবার আমাকে একজন গথ মেকাপ করার কারণে "ইলুমিনাতি" বলেছিলেন। রেড ফেস ডেভিল মেকাপ করে গালি খেতে হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে আমার দর্শক বদলেছে। অল্প কিছু মানুষ বাদ দিলে বাকিরা এখন ভালোই।'

মহামারি চলাকালে টিকটকের দুনিয়া আবিষ্কার করেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী তাজরীন খান।

তিনি বলেন, 'আমার ছোট বোনকে টিকটক চেনাই। মজা করে ছোট ছোট ভিডিও বানাতাম, বেশি ভিউ আসত না। এরপর হঠাৎ একদিন দেখি ওমা, ১ লাখ ভিউ! এরপর থেকে ভালোই ভিউ আসত। এখন আমি নাচি, কমেডি করি, নানান ধরণের কনটেন্ট বানাই।'

তাজরীন টিকটকে পরিচিত @typicaltazzz নামে।

তিনি বলেন, 'যখন আমি শুরু করি, তখন অনেকেই টিকটকের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা রাখতেন। বেশি ভালো কনটেন্ট ছিল না। তবে আমার ধারণা এখন মানুষ ধীরে ধীরে বুঝছে এই অ্যাপে কতকিছু রয়েছে। ফলে এখানে তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। কোয়ারেন্টিন শুরুর পর থেকে সব মিলিয়ে টিকটকের কনটেন্টের অনেক উন্নতি হয়েছে।'

এই অ্যাপে থাকা বেশ পরিশ্রমের ব্যাপার জানিয়ে তাজরীন বলেন, 'টিকটক খুব কৌশলী অ্যাপ। এর মেকানিজম বুঝতে সময় লাগে। ভোল পাল্টানোর ব্যাপারে টিকটক বেশ বিখ্যাত। অনেক ইফেক্ট আছে যেগুলো কীভাবে কাজ করে তা শিখতে হয়। একটা ভিডিও ১৫ সেকেন্ডের হলেও তার জন্য ৬-৭টা টেকও নিতে হতে পারে।'

'আমরা সবসময় ভাবি, বাংলাদেশের মানুষ স্রোতের বিপরীতে চিন্তা করতে পারে না। তবে টিকটক আমাকে দেখিয়েছে যে আমরাও পারি। এখানে মেকাপ করে এমন ছেলেরাও আছে। কিছু মানুষ থামতে বলার পরেও তারা থামছে না,' যোগ করেন তিনি।

টাইগার আইটি বাংলাদেশের কমিউনিকেশন এক্সিকিউটিভ ইরফান আজিজ বলেন, একসঙ্গে ভিডিও দেখতে দেখতে তার স্ত্রীর আগ্রহেই টিকটকে যোগ দিয়েছেন তিনি।

ইরফান বলেন, 'আমার ধারণা ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে মানুষ অনেক সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেদের উপস্থাপন করেন। নিজের পাগলাটে দিকগুলো প্রকাশ করব আর কেউ জাজ করবে না, এমন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টিকটককে নিরাপদ মনে হয়েছে। টিকটকে ভিডিও বানানো শুরু করেছি কারণ এখানে আমার বন্ধুরা কেউ ছিল না। তারা যতদিনে জানতে পেরেছে, ততদিনে আমার ফলোয়ার জমে গেছে, বন্ধুরাও বুঝেছে একটু ভাঁড়ামো করলে ক্ষতি নেই।'

ত্বকের যত্ন নিয়ে তিনি যখন ভিডিও বানান, বিনিময়ে সাড়া পেয়ে বুঝে যান এই অ্যাপে কী ধরণের মানুষ আছে। 'আমার ভিডিওতে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি বেশ। তা না হলেও টিকটক সবসময় আপনার পাশে দাঁড়াবে। আমার মনে আছে ত্বকের যত্ন নিয়ে বানানো ভিডিওতে যখন কিছু বাজে মন্তব্য পেয়েছিলাম, প্রত্যেকটার জবাবে ২-৩ জন করে আমার পক্ষে কথা বলছিলেন,' যোগ করেন তিনি।

তাজরীনের জন্যও এই অ্যাপ বেশ নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমার পরে অনেকেই জয়েন করেছেন, টিকটকে বন্ধুও বানিয়েছি। ভালো কনটেন্ট নির্মাতাদের দেখে সুন্দর সময় কাটে। মনে হয় আমিও তাদের দলে আছি, আমার একটা জায়গা আছে।'

টিকটক শুরু হয় ২০১৮ সালে। সময়ের ব্যবধানে নানান কারণে টিকটক নিয়ে নেতিবাচক খবর হতে থাকে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে 'তরুণ প্রজন্মের সামাজিক অবক্ষয় রোধ' করতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী রিট আবেদন করেন অ্যাপটি নিষিদ্ধ করার জন্য। তিনি বলেন, এই অ্যাপের কারণে তরুণ প্রজন্ম 'নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ হারাচ্ছে'।

২০২১ সালে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় টিকটকের মাধ্যমে নারী পাচার করার চক্রান্তে। যুগ যুগ ধরে মানব পাচারের সমস্যা চলমান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানব পাচারকারীরা বিভিন্ন পন্থায় এই অপরাধ করে থাকে। সেখানে এই সমস্যায় টিকটকের দোষ দেওয়াটা বিতর্কের দাবি রাখে।

সবাই যদি একই ট্রেন্ড আর চ্যালেঞ্জের পিছু ছোটে, তাতে সময়ের সঙ্গে মানুষের চিন্তাভাবনা অসাড় হয়ে যায় কি?

এর বিপক্ষে নিজের যুক্তি দেন একজন টিকটক ব্যবহারকারী এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মুরসালিন হাসান চৌধুরী আলফী।

তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় টিকটক চিন্তাভাবনার অসারতা কিছুটা হয়তো উৎসাহিত করে। কিন্তু যারা এসব অনুকরণ করে, তারাও নিজেদের মনের মতো করেই করে। একেকজন কীভাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে এসব ভিডিও বানায়, দেখাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। আর এসব চ্যালেঞ্জও তো কারো একার বা দলগত চিন্তার ফল। এভাবেও তো মৌলিক চিন্তা করছে মানুষ।'

টিকটকের অ্যালগোরিদমের কারণেও বিভ্রান্তিতে পড়েন অনেকে।

অ্যাপে নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাজরীন বলেন, 'প্রতি ৬-৭ মাস পর পর অ্যালগোরিদম বদলায়।'

'হুট করে নানান জিনিস হাজির হবে আর পছন্দের নানান কিছু দেখতে পাব। এরপর যখন আমার ভিডিওগুলো ভালো হতে শুরু করল, বুঝলাম অ্যালগোরিদম বদলে গেছে। কয়েক মাস পর আবার দেখা যাবে "ক্রিঞ্জ" কনটেন্ট দিয়ে ভর্তি। যেমন, আমার "ফর ইউ পেইজ" এ ভিডিওগুলোর ভিউ দেখাবে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার। এরপর হঠাৎ করে ১ হাজারে নেমে আসবে কোনো একটা ভিডিওতে। ৫-৬ দিন পর দেখা যাবে ১০ হাজার ফলোয়ার থাকলেও ভিউ আসছে কেবল ১ হাজার,' ব্যাখ্যা করেন তিনি।

তাজরীন আরও বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এসবে কষ্ট পাওয়ার বয়স আমার চলে গেছে। তবে আমার অনেক ফলোয়ার ছিল, হঠাৎ কমে গেল। আমার বন্ধুরা আনফলো করা শুরু করল, তারও ফলোয়ার কমে গেল। প্রতি ৬ মাস পর এর অ্যালগোরিদম বদলায় আর ভিন্ন ভিন্ন ধরণের মানুষ এখানে মনোযোগ পায়।'

ট্রিভেন্ট নামে ঢাকার একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সহপ্রতিষ্ঠাতা নাহিয়ান ইবনাত বেগ। টিকটক কীভাবে ছোটখাটো ব্যবসাগুলোতে প্রভাব ফেলে তা জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। তিনি জানান, টিকটকের এলোমেলোভাবে ভিডিও বুস্ট করার অ্যালগোরিদম তার কাজে দিয়েছে।

তিনি বলেন, 'কিছু আন্তর্জাতিক পেইজকে দেখেছি আমার ফর ইউ পেইজে তাদের নিজেদের ব্যবসার প্রচারণা চালাতে। কোনোটার অনেক অনেক ভিউ, আবার কোনোটার প্রায় কিছুই নেই। যখন দেখলাম কেউ এই প্ল্যাটফর্মকে ইভেন্ট বিষয়ক সার্ভিসের জন্য ব্যবহার করছে না, আমি সুযোগটা নিয়েছি।'

তিনি আরও বলেন, 'মনে ভরসা রেখে ভিডিও আপলোড শুরু করি। শুরুতে বেশি সাড়া পাইনি। তবে, সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। আমরা বুঝতে পারি মানুষ আমাদের কনটেন্ট পছন্দ করছে। ফলে আরও বেশি পোস্ট করি। কিছু বিশেষ ইভেন্টের পর ফলোয়ার আরও বেড়ে যায়। তখন থেকেই আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।'

অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের থেকে টিকটকে বাড়তি কী পাচ্ছেন জানতে চাইলে নাহিয়ান বলেন, 'আমাদের ভিউ বেড়েছে, রিচ বেড়েছে, দর্শকের পরিধি বেড়েছে, সম্ভাব্য ক্রেতা বেড়েছে। হুট করে ক্রেতার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। অটোমেটেড ভিডিও মেকিং আর এডিটিং আমাদের অনেক কিছু করার সুযোগ করে দিয়েছে। আগে অনেক জটিল অ্যাপ বা সফটওয়্যার দিয়ে এসব করতে হতো।'

দ্য ডেইলি স্টারের মাল্টিমিডিয়া টিমের সহকারী প্রযোজক শোভী জিবরান জানান, টিকটকের অ্যালগোরিদম সাহায্য করেছে তাকেও।

তিনি বলেন, 'লকডাউনে কিছু বন্ধু মিলে ফেস মাস্কের ব্যবসা শুরু করেছিলাম। ছোট ব্যবসা, বাজেট কম। এই অ্যাপ থাকায় নিত্যনতুন দর্শক আর ক্রেতা ধরতে পেরেছি।'

তিনি আরও বলেন, 'টিকটক তাদের ভিডিওগুলো কোনো ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দেবে না। আপনি কোনো হ্যাশট্যাগ দেন, আরও মানুষ একই হ্যাশট্যাগ দিলে সবগুলো ভিডিও একসঙ্গে দেখতে পাবেন।'

টিকটক জনমনে জায়গা করে নিয়েছে তা স্পষ্ট। অনেকের কাছে অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসি লুপিতার কাছে। তার কাছে জানতে চাই, নতুন কী ঘটছে।

তিনি বলেন, 'আমি এখন কম কম টিকটক বানাই। সপ্তাহে একদিন বা যখন মন চায়।'

তবে তার ফেস আর্ট ভিডিও তার জন্য খুলে দিয়েছে নতুন দুনিয়া। লুপিতা এখন একজন সদ্য প্রস্ফুটিত মেকাপ আর্টিস্ট। তার টিকটক ফিড ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, মেকাপ অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য তাকে নক করার লিংকও দেওয়া রয়েছে।

অনুবাদ করেছেন আনজিলা জেরিন আনজুম

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

6h ago