অনুভবের যৎসামান্য (৩)

একজন ইমতিয়াজ মাহমুদ

বহুদিন ধরে বাংলাদেশ এরকম ঘটনা দেখেনি। কী ঘটনা? একজন কবির জন্য গভীর উৎকণ্ঠা আর তীব্র ভালোবাসার ঘটনা। তিনি ইমতিয়াজ মাহমুদ। থাইরয়েড-ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন ইমতিয়াজ, চেন্নাইয়ের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, সার্জারি হবে কালকেই, এই খবরে উৎকণ্ঠিত-উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের সাহিত্য-সমাজ। তাঁর জন্য শুভকামনায়, প্রার্থনায়, ভালোবাসায় ভরে উঠেছে ফেসবুক। খবরটা পাওয়ার পর আমি ভেবেছিলাম, উৎকণ্ঠা-দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ কেবল আমারই, কিংবা আমার মতো আরো কয়েকজনের যারা ইমতিয়াজকে ভালোবাসেন। কিন্তু অচিরেই ভুল ভাঙলো। অসংখ্য মানুষ লিখলেন তাঁকে নিয়ে, উৎকণ্ঠা আর ভালোবাসার কথা জানালেন, আবেগভরা কথামালা গাঁথলেন, রোগমুক্তির জন্য আকুতি ও প্রার্থনা জানালেন, আরো কত কি!

বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে, জীবদ্দশায় এবং অল্প বয়সে, এরকম ভালোবাসা এর আগে পেয়েছিলেন কেবল আবুল হাসান। হাসানের অকালপ্রয়াণ এখনো সাহিত্যপ্রেমিদের বুকে ক্ষত হয়ে আছে। ইমতিয়াজের ক্যান্সার-আক্রান্ত হবার খবরে যেন তেমনই এক আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছে সবাই। 

কিন্তু কেনই-বা তাঁর জন্য এরকম উপচে-পড়া-ভালোবাসা সবার? অসামান্য সব কবিতা লেখেন ইমতিয়াজ, সন্দেহ নেই। তিনি এমন এক কবি যে, তাঁর যেকোনো একটি কবিতা পড়লেও একজন পাঠক তাঁর আরেকটি কবিতা খুঁজবেন। কারণ তাঁর প্রায় সব কবিতাই আত্মাকে স্পর্শ করে, হৃদয়কে বিদ্ধ করে। এমনকি তাঁর দুলাইনের কবিতাগুলো, তিনি ডাকেন কাপলেট বলে, কিংবা এক লাইনের ম্যাক্সিম বা প্রবচণগুলোও দারুণ ভাবায় পাঠককে।  যে-ধরনের সিগনেচার থাকলে একজন কবিকে/লেখককে/ শিল্পীকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়, যে-ধরনের সিগনেচারের জন্য সৃজনশীল মানুষেরা জীবনভর অপেক্ষা করেন, ইমতিয়াজ খুব অল্প বয়সেই তা আয়ত্ত্ব করে নিয়েছেন। তাঁর প্রতিভা প্রকৃতিপ্রদত্ত, ঠিক ব্যাখ্যা করে ওঠা যায় না। এর সবই সত্যি, কিন্তু তবু, এই দেশে কেবল কবিতা লিখে এরকম বিপুল ভালোবাসা অর্জন করা বিস্ময়ের জন্ম দেয় বৈকি!
 
তাহলে কি তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের ভেতরে এমন কিছু আছে যা মানুষকে বিপুলভাবে আকর্ষণ করে? তাও তো মনে হয় না। আপাতদৃষ্টিতে তিনি বেশ অসামাজিক এবং অমিশুক ধরনের মানুষ। অনেক বছর ধরে তাঁকে কোথাও দেখা যায় না, মানে তিনিই যান না কোথাও; আড্ডায়, অনুষ্ঠানে, সমাবেশে, মেলায় তাঁর অনুপস্থিতিই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। হয়তো দু'চাজন নির্বাচিত মানুষ ছাড়া কারো সঙ্গে কথাও বলেন না, সামনাসামনি বা ফোনে। তাঁর সঙ্গে পাঠকের যোগাযোগ হয় কেবলমাত্র ফেসবুকে, তাঁর লেখায়। কিন্তু সেখানেও তিনি স্বেচ্ছাচারি। নিজের পোস্টে কারো মন্তব্য যদি তাঁর পছন্দ না হয়, কিংবা তাঁকে নিন্দা করা অন্য কারো পোস্টে তাঁর ফেসবুক বন্ধুদের কেউ যদি লাইক দেয় তাহলে তিনি বলে-কয়ে অবলীলায় তাকে আনফ্রেন্ড বা ব্লক করেন। আমার এই লেখাটি যদি চোখে পড়ে ইমতিয়াজের, বলা যায় না, 'কী লিখেছেন এসব, কামাল ভাই' বলে আমাকেও আনফ্রেন্ড করে দিতে পারেন তিনি। আমি মোটেও অবাক হবো না তাতে। ফেসবুকে তাঁর এই ধরনের 'অসহিষ্ণু' আচরণে ক্ষুব্ধ হন প্রায় সকলেই। এরকম মানুষদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার কোনো কারণ তো নেই। তবু বহু মানুষ তাঁকে পছন্দ করেন কেন? আচ্ছা, আসুন, আরেকটু ভেবে দেখা যাক। 

খানিকটা খেয়ালি এবং ক্ষ্যাপাটে মানুষ ইমতিয়াজ। নিজের মতো থাকেন, নিজের মতো চলেন, নিজের মতো করেই বলেন, কারো ধার ধারেন না। ঘোষণা দিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখা বন্ধ করেছেন তিনি অনেক বছর আগে, কোনো সংকলনেও লেখা দিতে অনিচ্ছার কথা জানিয়েছেন, কেবল ফেসবুকেই লেখেন তিনি, তাও মেপে মেপে, আর কয়েক বছর পরপর প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতার বই। এই তো! না, আরেকটু বলি। তিনি এই দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চাকরি করেন – বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য হিসেবে। কিন্তু সেখানেও, পেশাগত উন্নতির প্রশ্নে,  তিনি খেয়ালি এবং উদাসীন। তাঁর ব্যাচমেটদের প্রায় সবাই উপসচিব হয়ে গেছেন অনেক আগেই, কিন্তু তিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই আছেন এবং প্রায় দেড় যুগ ধরে তিনি তাঁর প্রমোশন ঠেকিয়ে রেখেছেন। উঁচুপদে যাওয়ার জন্য যে প্রফেশনাল পরীক্ষা দিতে হয় তিনি তা দেনইনি। মেধাবী তিনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন, বিসিএস নামক সোনার হরিণ জয় করেছেন; এমন তো নয় যে, পরীক্ষাকে ভয় পান বলে প্রমোশনের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাটি দেননি! তাহলে? আসলে তাঁর এইসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর চরিত্রের অনন্যতা। প্রতিষ্ঠা ও সাফল্য, ক্ষমতা ও প্রচারসর্বস্বতাকে তিনি অবলীলায় অস্বীকার করেছেন, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সমস্ত রকমের ইঁদুর-দৌড়-প্রতিযোগিতা থেকে। আমাদের সাহিত্যসমাজ (এবং সার্বিকভাবে জনমানুষের সমাজও) যখন ধান্দাবাজি, দলাদলি, গ্রুপিং-লবিং, ক্ষমতা-লিপ্সা, ক্ষমতার দম্ভ, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-ঘৃণা ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ তখন তিনি এক অদ্ভুত নিরাসক্ত, নির্লিপ্ত, নির্মোহ জীবন বেছে নিয়েছেন। সমাজের গ্লানি, ক্লেদ, পঙ্কিলতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আর সেজন্যই তিনি হতে পেরেছেন সৎ, সরল, অকপট, সাহসী। ব্যক্তিজীবনের এই চরিত্র মিলে গেছে তাঁর কবিচরিত্রের সঙ্গেও; তাঁর কবিতাও তাই সৎ, অকপট, সরল, সাহসী। শিল্পীদের ব্যক্তিচরিত্র আর শিল্পীচরিত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেলে না। ইমতিয়াজ সেই বিরল কবিদের একজন, যিনি এই দুই চরিত্রকে মেলাতে পেরেছেন। এরকম মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায়?

কেমন কবিতা লেখেন ইমতিয়াজ মাহমুদ? জীবন ও জগতের সঙ্গে এক গভীর ও স্বচ্ছ বোঝাপড়া আছে তাঁর, বহুবিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখেন তিনি এবং লেখেন এক হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গি ও ভাষায়। গভীর উপলব্ধির জগৎকে এবং জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তাঁর দার্শনিক অনুসন্ধান ও অবস্থানকে তিনি প্রকাশ করেন সহজ ভঙ্গিতে। সেই ভঙ্গি ও ভাষার ভেতরে দরদ  থাকে, মায়া থাকে, থাকে বিষাদ ও বিপন্নতা; কখনো-কখনো থাকে তীব্র শ্লেষ, বিদ্রুপ, কটাক্ষ, উপহাসও। সব মিলিয়েই তিনি আমাদের হৃদয়ের কাছে অবস্থান নেন, হয়ে ওঠেন আমাদেরই প্রিয় একজন, আমাদের ইমতিয়াজ মাহমুদ। 

তাঁর প্রথম কবিতার বই 'অন্ধকারের রোদ্দুরে' প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে, এরপর প্রকাশিত হয়েছে আরো আটটি কবিতার বই। শেষটি ২০১৯ সালে, 'গন্ধমফুল'। এই লেখায় তাঁর প্রকাশিত তিনটি বই থেকে কিছু কবিতা তুলে দিচ্ছি।  আসুন পড়া যাক :

প্রথমটির শিরোনাম, 'যদি', পেন্টাকল বই থেকে-
 
'যদি চুরির অভিযোগে এক দুপুরে তোমার চাকরি চলে যায় আর তার পরদিন
হাতে পাও তোমার বউয়ের ডিভোর্স লেটার। পত্রটা পুরো পড়ার আগেই
শোনো মাদক হাতে ধরা পড়েছে তোমার ছেলে। আর তোমার মেয়ের গোপন
ভিডিও ছড়ায়ে পড়েছে পৃথিবীর অন্তর্জালে। যদি তুমি রেললাইনে মরতে
যাও আর রেলগাড়ি তোমার মাথা কাটার বদলে পা দুটো কেটে ফেলে।
যদি লোকজন তোমাকে ধরে শোয়ায়ে রাখে পঙ্গু হাসপাতালে। যদি চোখ
খুলে তুমি দেখতে পাও তোমাকে দেখতে এসেছে তোমার
বউ/ছেলে/মেয়ে। যদি তারা পেয়ারা নিয়ে আসে। যদি সবুজ সে পেয়ারা
পড়ে থাকে টেবিলের উপরে। তখন তুমি ভাবতে পারো, কী সুন্দর সবুজ
পেয়ারা! এমন জীবন কয়টা মানুষইবা পায়? যদি না পেয়ারার অর্ধেকটা
তোমার আগেই ক্ষুধার্ত কোন ইঁদুর খেয়ে যায়!' (যদি / পেন্টাকল)

এর পরেরটির শিরোনাম 'জীবনের প্রকার', 'কালো কৌতুক' বই থেকে-

'এই জীবন ভালো না লাগায় একদিন নদীর কাছে গেলেন।
শোনা যায় যে নদীতে ঠিকমতো একটা ডুব দিতে পারলে
অন্য আরেকটা জীবন পাওয়া যায়। আপনি সেই জীবনের
আশায় ডুব দিলেন। ডুবটা খুব ভালো হয়েছিল, কেননা
একটু পর আপনি একটা চিতল মাছ হয়ে ভেসে উঠলেন।

দুই

এর পরের গল্প তো সবার জানা। এক জেলে জাল পেতে
আপনাকে শিকার করল, তারপর বাজারে বিক্রি করল,
বাজার থেকে আপনার বাবা আপনাকে খুব দরদাম করে
কিনে আনল, তারপর আপনার বউ আপনাকে কেটেকুটে
চুলার উপর তপ্ত কড়াইতে ছেড়ে দিলো / জীবন একই রকম!'

(জীবনের প্রকার / কালো কৌতুক)

এর পরেরগুলো সর্বসাম্প্রতিক বই গন্ধমফুল' থেকে। এগুলোর  অধিকাংশই এক বা দু' পঙক্তির, কোনো-কোনোটি চার পঙক্তির, তিনি ডাকেন 'ম্যাক্সিম' বলে। কিন্তু আমার কাছে এগুলো কবিতাই। দেখুন, কত বিচিত্র বিষয়ে কী উজ্জ্বল সব পঙক্তি ছড়িয়ে রেখেছেন তিনি । 
 
•    জালে আটকালে তাও নিয়তিকে দোষারোপ করা যায়,
বড়শিতে আটকালে কেবল নিজেকে। (মাছ /গন্ধমফুল)

•    দুটি গরু একত্র হলে মূলত ঘাসের আলাপই করে (প্রকৃতি / /গন্ধমফুল)

•    আত্মীয়স্বজনই মানুষকে কবরে শুইয়ে দেয়
কাউকে মৃত আর কাউকে জীবিত।

•    মানুষের দেহের তিন ভাগ জল
আর এক ভাগ খল (দেহতত্ত্ব /গন্ধমফুল)

•    আদম নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো সিংহল দ্বীপে,
ইভ খোরাসানে, আর ইবলিশ ঢাকায়। (ঢাকা /গন্ধমফুল)

•    সব জায়গায় তেলের খনি থাকে মাটির নিচে,
শুধু বাংলাদেশে ওপরে। (তেল /গন্ধমফুল) 

•    নেতার সাথে হ্যান্ডশেক করার পর কর্মী তার হাতের দিকে
তাকিয়ে দেখলো, একটা আঙুল ফিরে আসেনি। (কর্মী /গন্ধমফুল)

•    মানুষ মারতে কয় টাকা লাগে?
বার্মায় দশ টাকা, বাংলাদেশে ফ্রি। (জীবনের মূল্য /গন্ধমফুল)

•    যারা সবসময় জিততে চায়, তারা জানে না
কোনো কোনো বিজয় পরাজয়ের চেয়েও কুৎসিত।  (পরাজয় /গন্ধমফুল)

•    পৃথিবী আমাকে সুন্দর যা কিছু দেয়. তার সবই 
মেরে ফেলার আগে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়। (ক্ষতিপূরণ /গন্ধমফুল)

•    মাথা ত্যাগ করা লোকেরা পদত্যাগ করে না। (পদত্যাগ /গন্ধমফুল)

•    ব্যর্থতা মানুষকে হতাশ করে, আর সফলতা করে শূন্য। (সফলতা /গন্ধমফুল) 

•    বৃক্ষ শুধালো, মানুষ তোমার পরিচয় কিসে?
মানুষ বললো, বিষে। (পরিচয় /গন্ধমফুল)

•    যে যত একা থাকে, সে তত গীবতমুক্ত থাকে। (গীবত /গন্ধমফুল)

•    অসুখী মানুষ যখন ঘুমায়,
তখনও তার চেহারায় দুঃখ জেগে থাকে। (দুঃখ /গন্ধমফুল)

•    ভাতে আমরা লবণ চাই না জনাব,
চোখের পানিতে অনেক লবণ আছে। (উন্নয়ন /গন্ধমফুল)

•    মানুষকে  হাসতে দেখে জেনেছি তার দাঁত আছে। ( মানুষ / গন্ধমফুল)

•    মানুষ স্বীকার করার আগেও এভারেস্ট
সবচেয়ে উঁচু ছিলো। (স্বীকৃতি / গন্ধমফুল)

•    রাস্তা আর বারান্দায় বসে বারো মাস গান গাইলে
কোকিলের সামাজিক মর্যাদাও কাকের মতো হতো। ( মর্যাদা / গন্ধমফুল)

•    ঘোড়া যত দিন দৌড়াতে পারে, তত দিন পরাধীন
অচল হয়ে গেলে স্বাধীন। (মুক্তি / গন্ধমফুল)      

•    এই পৃথিবী যতটা মানুষের, ততটা টিকটিকির। (পৃথিবী / গন্ধমফুল)

•    চোখের আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো যায়,
মোমবাতি ধরানো যায় না। (প্রতিহিংসা /গন্ধমফুল)

•    গাছের ছাল পরে ঘুরে বেড়ানো
মানুষগুলোর প্রধান দুশ্চিন্তা ছিলো ক্ষুধা, ভয়, মৃত্যু, 
অনিশ্চিয়তা ইত্যাদি। একুশ শতকের মানুষের প্রধান দুশ্চিন্তা
ক্ষুধা, ভয়, মৃত্যু, অনিশ্চিয়তা ইত্যাদি। (কতদূর এগোলে মানুষ / গন্ধমফুল)

•    নিজের চিৎকার নিজে গিলে ফেলার 
নাম হচ্ছে সহনশীলতা। (সহনশীলতা /গন্ধমফুল)
 

Comments