হুমায়ুন আজাদ: ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর

ছবি: সংগৃহীত

হুমায়ুন আজাদ যদি কোনো কিছুর প্রতিমূর্তি তুলে ধরে থাকেন তবে তা হলো—একটি প্রগতিশীল, স্বাধীন জাতির ধর্মনিরপেক্ষ নীতি। তাই তার জীবন ও কর্মকে সংক্ষেপে ধর্মীয় উগ্রবাদের অন্ধত্বের বিরুদ্ধে একজন মানুষের সংগ্রাম বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

ধর্মীয় উগ্রবাদীরা তাকে 'মুরতাদ' (ধর্মত্যাগী) বলে অভিহিত করেন এবং মৃত্যু মুখে পতিত হয়ে তিনি তার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি দৃঢ়তার মূল্য দেন। বহুত্ববাদের পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখার জন্য ধর্মান্ধদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেও তিনি কখনই এই অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা ছেড়ে দেননি।

মুক্তচিন্তার এই মশাল বাহকের লেখা ও বক্তৃতা সমাজের কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির ওপর আঘাত করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবির) বাংলার অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ছিলেন বহু প্রতিভার অধিকারী। একাধারে তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, কবি, ঔপন্যাসিক, কিশোর সাহিত্যিক, সমালোচক এবং কলামিস্ট। তার আদর্শ ও মানবতা বোধ সবার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে, বিশেষ করে তাদের জন্য যারা বাকস্বাধীনতা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার রক্ষায় কাজ করেন।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'তিনি (হুমায়ুন) ছিলেন মুক্তচিন্তা চর্চায় একজন অগ্রদূত। আজকাল সেলফ সেন্সরশিপের পাশাপাশি বেশ কিছু বাধার কারণে মুক্তচিন্তার চর্চা কমে যাচ্ছে। কেউই যদি তাদের মনের কথা ঠিক মতো প্রকাশ করতে না পারেন, তাহলে আমাদের সমাজ একটি বদ্ধ সমাজে পরিণত হবে। এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।'

তিনি বলেন, 'অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার কাজ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই শক্তিগুলো দেশকে পিছিয়ে দিয়েছে।'

হুমায়ুন আজাদকে তার সময়ের সেরা গদ্য লেখক বলে মনে করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'তার "প্রবচনগুচ্ছ" এক অসামান্য রচনা।'

২০০৩ সালের নভেম্বরে দৈনিক ইত্তেফাকের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় হুমায়ুন আজাদের 'পাক সার জমিন সাদ বাদ', যা পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ পায়। ধর্মীয় উগ্রবাদের তীব্র সমালোচনা করে লেখা এই বইয়ের জন্য তখন থেকেই জঙ্গিদের কাছ থেকে হুমকি পেতে শুরু করেন তিনি।

এই বইটি ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাবিদদের প্রশংসা অর্জন করলেও ধর্মান্ধদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে বছর ডিসেম্বরে বায়তুল মোকাররম মসজিদে একটি বিক্ষোভে ভাষণ দিয়ে আহমেদিয়া বিরোধী দলের নেতারা উপন্যাসটির জন্য হুমায়ুন আজাদকে গ্রেপ্তার ও তার বিচারের দাবি জানান।

২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী 'এই ধরনের বই' প্রকাশ বন্ধ করার জন্য ব্লাসফেমি আইন প্রবর্তনের দাবি জানান।

এক মাস পর ২৭ ফেব্রুয়ারি জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা একুশে বইমেলা থেকে ফেরার সময় বাংলা একাডেমির কাছে অধ্যাপক হুমায়ুনের ওপর হামলা চালান। এতে গুরুতর আহত হন তিনি।

এই হামলার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখে মারা যান হুমায়ুন। তিনি ১৯৪৭ সালে মুন্সীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।

রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে পচনের ফলে সৃষ্ট সামরিক স্বৈরাচারের ভূমিকার ওপর তার 'ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল' উপন্যাসটি সর্বাধিক বিক্রিত বই এবং এটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। 'সব কিছু ভেঙে পড়ে'সহ তার উপন্যাসগুলো সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন দ্বন্দ্বকে চিত্রিত করেছে।

নারীবাদের ওপর তার বই 'নারী' ১৯৯৫ সাল থেকে ৪ বছরেরও বেশি সময়ের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তিনি ফরাসী অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সিমোন ডি বেউভোয়ারের 'দ্য সেকেন্ড সেক্স' এর অনুবাদ 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' লিখেছেন।

হুমায়ুন আজাদের প্রায় ৭০টির বেশি বই প্রকাশকারী আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণির মতে, মুক্ত চিন্তাবিদরা এই বই ২টিকে স্বাগত জানালেও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা অপছন্দ করেছে।

সাহিত্য সমালোচনার ওপর তার বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা 'শামসুর রাহমান/ নিঃসঙ্গ শেরপা', 'ভাষা আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি', 'আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম'সহ বেশ কয়েকটি বইয়ে লক্ষ্য করা যায়।

হুমায়ুন আজাদ জীবনের প্রথম দিকে কবিতা লেখা শুরু করেন। তার লেখা কবিতার বই ও কবিতা 'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে' পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে গেছে। আজও এই কবিতার উক্তি সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।

১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অলৌকিক ইস্টিমার' এবং প্রবন্ধের বই 'রবীন্দ্র প্রবন্ধ: রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা'।

কিশোরদের জন্য তার বই 'আব্বুকে মনে পড়ে' জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অনেকে মনে করেন বাংলা ভাষায় 'কত নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী' এবং বাংলা সাহিত্যে 'লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী' তার রচিত ২টি আকর এবং বহুল প্রশংসিত গ্রন্থ।

তার পিএইচডি গবেষণামূলক প্রবন্ধ 'প্রনোমিনালাইজেশন ইন বেঙ্গলি' এবং 'বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র', 'বাক্যতত্ত্ব'র মতো ভাষাতত্ত্বের বই শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল।

হুমায়ুন আজাদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, '"শামসুর রাহমান/ নিঃসঙ্গ শেরপা", "লাল নীল দীপাবলি", বাংলা ভাষার ওপর ২ খণ্ডের প্রবন্ধ "বাঙলা ভাষা" শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে বিবেচিত হয়।'

হুমায়ুন একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেন চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসেবে। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।

১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সাহিত্য ও ভাষাবিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।

ওসমান গণি বলেন, 'হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুতে সাহিত্য জগতে এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে এবং সেই শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি।'

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের সমাজে প্রতিবাদের চেতনা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। আমরা কোনো প্রশ্ন বা বিতর্ক না করেই সবকিছু মেনে নেই। আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তাতে হুমায়ুন আজাদ অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।'

Comments

The Daily Star  | English

Abdul Hamid returns home after treatment in Thailand

Two police officials were withdrawn and two others suspended for negligence in duty regarding the former president's departure from the country

2h ago