মুক্তিযুদ্ধ

৩ নভেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে ১৩ রমজান

(পবিত্র কোরআনে রমজানকে রহমতের মাস বলা হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা এই মাসে বর্বরোচিত গণহত্যা, নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। অন্যদিকে, প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য এ মাসে রণাঙ্গনে প্রাণপণে লড়াই করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রোজা পালনরত অবস্থাতেই স্বদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাস কেমন ছিল, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজনের আজকের পর্বে রইল ১৩ রমজানের ঘটনাপ্রবাহ।)

মুক্তিযুদ্ধে ১৩ রমজান পালিত হয়েছিল ৩ নভেম্বর। দিনটি ছিল বুধবার। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য দিনের মতো এদিনও গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

১৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে যশোরের চৌগাছায় লেফটেন্যান্ট অনিক গুপ্তের নেতৃত্বে গণবাহিনী ও ইপিআরের ৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর চৌগাছা বিওপি আক্রমণের লক্ষ্যে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে। সকাল ৯টার দিকে হানাদার বাহিনীর একটি পেট্রোল পার্টিকে আসতে দেখে আক্রমণ শুরু করে ইপিআর ও গণবাহিনীর দলটি। এ সময় বিওপি থেকে হানাদারদের আরেকটি দল এসে গেরিলাদের ঘিরে ফেললে ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

তখন ক্যাপ্টেন নজমুল হুদার নেতৃত্বে আরেকটি দল চৌগাছা বিওপির সামনে এসে আগের দলটির সঙ্গে যোগ দেয়। এ ছাড়া, ভারতীয় সেনারা দূর থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আরও শক্তিশালী হয় এবং হানাদাররা বিওপি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৪০ সেনা নিহত হয় এবং ইপিআরের এক ল্যান্স নায়েক আহত হন। পরে ইপিআরের মুক্তিযোদ্ধারা চৌগাছা বিওপি থেকে স্টেনগান, চাইনিজ রাইফেল, এলএমজি, ওয়্যারলেসসহ বহু গোলাবারুদ উদ্ধার করে।

১৩ রমজান সকালে ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল রাঙ্গামাটি রোডে একটি ব্রিজ ধ্বংসের চেষ্টা করে। হঠাৎ সেখানে একটি পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও রাজাকারদের পেট্রোল পার্টি চলে আসে। মুক্তিবাহিনীর দলটি কিছু বোঝার আগেই গেরিলা পরিমল সরকারকে ধরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে যায় রাজাকার ও মিলিশিয়াদের দলটি। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর দলটি নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে আরও সংগঠিত হয়ে হানাদারদের ক্যাম্পে হামলা শুরু করে। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৪ সেনা নিহত হয়। একজন গেরিলা আহত হন।

মুক্তিযুদ্ধের ১৩ রমজান টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীতে কাদেরিয়া বাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায়। তখন হানাদার বাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে এক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

মুক্তিযুদ্ধের ১৩ রমজান রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌ কমান্ডোরা ১ হাজার টন কেরোসিন ও ৩০ টন গ্যাসোলিনবাহী 'মাহতাব জাভেদ' নামের একটি পাকিস্তানি জাহাজ ডুবিয়ে দেন। নৌ কমান্ডোদের হামলায় ৩ বার জাহাজে বিস্ফোরণ হয় এবং জাহাজের ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার ব্রিগেডের দল ১ ঘণ্টা ধরে অভিযান চালিয়েও আগুন নেভাতে পারেনি। পরে জাহাজে মাইন বিস্ফোরণে ৩ জন অগ্নিনির্বাপক কর্মী ও জাহাজের এক ক্রু  নিহত হয়। আহত হয় প্রায় ৩০ জন। নৌ কমান্ডোদের এই জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার খবর বিদেশি গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়। 

১১ নম্বর সেক্টরের মহেশখোলা সাব সেক্টরের আওতাধীন ছিল দুর্গাপুর। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী সেখানকার সীমান্ত সংলগ্ন প্রতিটি রাস্তায় নিয়মিত পেট্রোলিং করত। ফলে মুক্তিবাহিনীর চলাচলে সমস্যা হতো। ১৩ রমজান মুক্তিবাহিনীর একটি দল সেখানে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। দুর্গাপুর সড়কের কাছে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে তারা। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শুরু করেন। এ সময় ২ হানাদার সেনা নিহত এবং একজন  আহত হয়। বাকিরা পালিয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল গাইবান্ধার বালাসিঘাট। পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিত গাইবান্ধা থেকে বালাসিঘাটে টহল দিত। পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিতই স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর নিত। ফলে বালাসিঘাটের দখল নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর মাহবুব এলাহী রঞ্জুর নেতৃত্বাধীন রঞ্জু কোম্পানি বালাসিঘাট দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৩ রমজান আগেভাগেই সেহরি খেয়ে মাহবুব এলাহী রঞ্জুর মুক্তিযোদ্ধারা বালাসিঘাটে অ্যামবুশের ফাঁদ পাতেন।

সকালের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর বড় একটি টহল দল বালাসিঘাটের দিকে যাওয়ার পথে অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। বৃষ্টির মতো গোলাগুলিতে পাকিস্তানি বাহিনী হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তুললে হানাদারদের মেশিনগানের গুলিতে ফজলু নামের এক মুক্তিযোদ্ধা রোজা পালনরত অবস্থায় শহীদ হন। তাজুল ইসলাম টুকু নামের আরেক মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হন।

পরে শহীদ ফজলুকে কালাসোনারচরে সামরিক কায়দায় শ্রদ্ধা জানিয়ে দাফন করা হয়। শহীদ ফজলুর প্রতি সম্মান জানিয়ে কালাসোনাচরের নাম পাল্টে ফজলুপুর ইউনিয়ন করা হয়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম এবং দশম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর  ২, ৬, ৮, ১০ ও ১১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

BNP hosts discussion on first anniversary of July uprising

Leaders recall sacrifices, call for unity at Dhaka gathering

46m ago