ঈদে বিপন্ন জীবনে ছুটেছে মানুষ

আমরা ধরে নেই লোকটি একজন ফেরিওয়ালা। মাথায় তার চাঙারি, বিক্রি করে মাছ। গ্রামে নয়, শহরেই, এই রাজধানীতেই। হাঁক দিয়ে যায় পাড়ায় পাড়ায়। কিন্তু একদা সে গ্রামে ছিল। জেলে নয়, চাষি। জমিজমা বেদখল ও ভাগাভাগি হয়ে গেছে। যা ছিল সেটুকু হাতছাড়া হওয়ার আগে বিক্রি করে দিয়ে এখন ফেরিওয়ালা হয়েছে।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

আমরা ধরে নেই লোকটি একজন ফেরিওয়ালা। মাথায় তার চাঙারি, বিক্রি করে মাছ। গ্রামে নয়, শহরেই, এই রাজধানীতেই। হাঁক দিয়ে যায় পাড়ায় পাড়ায়। কিন্তু একদা সে গ্রামে ছিল। জেলে নয়, চাষি। জমিজমা বেদখল ও ভাগাভাগি হয়ে গেছে। যা ছিল সেটুকু হাতছাড়া হওয়ার আগে বিক্রি করে দিয়ে এখন ফেরিওয়ালা হয়েছে।

ভূমি এখন তার মাথায়, বিক্রি করে পাওয়া টাকাটাই পুঁজি। কত টাকার মাছ আছে তার ঝুড়িতে? হাজার তিনেক! সে মাছ সে খায় না। খাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবে না। তার স্ত্রী মাছ রান্না করছে, সে পরিবারের সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে বসে মাছে-ভাতে খাবার খাচ্ছে এটা স্মৃতি হিসেবে ঝাপসা, স্বপ্ন হিসেবে সুদূরের। কিন্তু এখন সে পা রাখে কোথায়? জনাকীর্ণ, মানুষের ভারে ডুবু ডুবু ঢাকায় তার আশ্রয় কোনখানে? কোন বস্তিতে? আমরা জানি না। জানার আগ্রহ নেই। জানা সম্ভব নয়।

তবে এটা নিশ্চিত জানি যে, এবারের ঈদে যে হাজার হাজার, হাজার কেন বলছি লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও গ্রামের দিকে ছুটছে এই ফেরিওয়ালাটি তাদের একজন নয়। যারা বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে যে যেভাবে পারে গ্রামে ছুটেছে সেখানে তাদের একটা আশ্রয় আছে, এই মানুষটির জন্য সে রকম কিছু নেই। এই লোকটি একেবারেই নিরাশ্রয়, তবে মনে মনে আর পাঁচজনের মতোই সেও গৃহী বৈকি।

এই মানুষটি একা নয়, এমন হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ নর-নারী রয়েছে এই শহরে। যাদের জীবনে কোনো ছুটি নেই, ঈদ নেই। ছুটি নিলেই অনাহার। এরা পুঁজি যেটুকু আছে আঁকড়ে ধরে রাখে। কেননা জানে, যেকোনো মুহূর্তে তা বেহাত হয়ে যেতে পারে। এদেরকে পুলিশে গুঁতোয়, মাস্তানরা চাঁদার জন্য শাসায়। গ্রামে যদি আশ্রয় থাকতো তাহলে জীবন বিপন্ন করে হলেও সেখানে ছুটতো, যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটেছে। কেননা গ্রামের ওই আশ্রয়ে জীবন আছে বলে তারা মনে করতো।

করোনার মধ্যেও অগণিত মানুষ ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু কই, তবু তো রাস্তাঘাট একেবারে যে ফাঁকা ঠেকবে তেমনটা ঠেকছে না। ভিড় কিছুটা কমেছে। কিন্তু সেই কমাটা আগের বছরগুলোর তুলনায় কম। শহরে মানুষ আছে, গাড়িও আছে। যারা বিত্তহীন তারা শহর ছেড়ে বের হতে পারেনি। যাওয়ার মতো ঠিকানা তো নেইই, যাবে যে তেমন খরচও হাতে নেই। গ্রামে ও মফস্বলে গেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত। গ্রামের আপনজনেরা সেখানে থাকে। আপনজনেরা অপেক্ষায় থাকে উপার্জনক্ষম প্রবাসী ব্যক্তিটি কখন দেশে ফিরবে। নিয়ে আসবে স্নেহ, মমতা, সঙ্গে আনবে উপহার, নানাবিধ।

একবার ছেলেবেলায় আমরা কিছুদিন গ্রামে ছিলাম। সে অনেক আগের কথা। আত্মীয়দের কেউ কেউ কলকাতায় থাকতেন, জীবিকার অন্বেষণে সেখানে গেছেন, রাজধানীতে থাকতেন একা একা, ছুটি পেলে বছরে একবার বাড়িতে আসতেন। সঙ্গে অন্যসব জিনিস তো আনতেনই, পাউরুটি, টিনের মাখন, প্যাকেটের বিস্কিট এসবও আনতেন। গ্রামে যেগুলো পাওয়ার প্রশ্নই উঠতো না। তখন হাটবাজারের দোকানিরাও খুশি হতো। তাদের বিক্রি-বেচা বেড়ে যেতো। গ্রামের সাধারণ মানুষ অবশ্য মৃদু আপত্তি করতো, কলকাতাওয়ালা এসে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে দেখে।

এখন কলকাতা নেই, ঢাকাই কলকাতা হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রাম থেকে কলকাতায় অত লোক যেত না, এখন যত লোক ঢাকায় যায়। কেবল ঢাকা কেন, পৃথিবীর হেন জায়গা নেই যেখানে বাংলাদেশের লোক নেই। উৎসবে তারাও আসতে পারে না, বড় জোর ফোন করে। এদিক থেকে তারাও বিত্তহীনদের দলে পড়ে, যদিও তাদের আয়-উপার্জন তুলনামূলকভাবে ভালো এবং গ্রামে তাদের সুস্পষ্ট বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য ঠিকানা রয়েছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা খারাপ নেই। ভাই, ছেলে, বাবার এমন কি মেয়ে বা বোনের পাঠানো টাকা দিয়ে তারা ঘরদোর ঠিক করে, দরজা জানালায় পর্দা টানায়, পারলে জমি কেনে, দোকানপাটও খোলে।

ছুটিতে ছুটতে ছুটতে পড়ি তো মরি হয়ে যারা দেশের বাড়িতে গেছে তাদেরকে আবার ঠিক ওইভাবেই ফিরে আসতে হবে, তবে করোনা নিয়ে আসাটাও অস্বাভাবিক নয়। করোনার সময়ে সেই ঠেলাঠেলি ঠাসাঠাসি ধাক্কাধাক্কি-বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে। সেই ওষ্ঠাগত প্রাণ। সময়মতো না ফিরতে পারলে চাকরি যাবে। শহর থেকে বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছেছে আপনজনেরা তখন ঈদের চাঁদ পেয়েছে হাতে। সুবাতাস বয়ে গেছে খুশির। কিন্তু তারাই, ওই আপনজনেরাই আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যদি দেখে প্রিয়জনটির তাড়া নেই ঢাকায় ফিরবার। তাহলে কি চাকরি নেই? কোনো সর্বনাশ কি ঘটে গেছে, যে জন্য বাড়িতে ফিরে এসেছে, ফেরত যাওয়ার জন্য উসখুস করছে না? এবং তারা স্বস্তি পায় যখন দেখে প্রিয়জনটি আবার রওনা হয়েছে বান্ধবহীন সেই মরুভূমিতে, রাজধানীর সেই অনিশ্চিত শহরে। কেননা প্রিয়জনেরা সকলেই নিকটজন তো অবশ্যই কিন্তু উপার্জনে অক্ষম হলে সে অতি প্রিয়জনটি বাড়ির গাছটিও নয়, এমনকি শুকনো কাঠও নয়, যেন সে ঝরে-পরা পাতা একটি।

কিন্তু কেন এমনটা ঘটলো? ঘটার প্রধান কারণ হচ্ছে উন্নতি। এ এক বিশেষ ধরনের উন্নতি, যাতে একজন ফুলে-ফেঁপে ফুড়ে ফাটিয়ে সিঁড়ি ভেঙে খাড়াখাড়ি উঠে যায় ওপরের দিকে, আর অন্য দশজন সেই উন্নতির বোঝা বহন করতে গিয়ে নানা মাত্রায় অবনত হতে থাকে। এই উন্নতির আরও একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সেটি হলো আত্মকেন্দ্রিকতা।

এক কথায় একে পুঁজিবাদী ধারার উন্নতি বলা খুবই সঙ্গত। উন্নতির এই ধারায় ব্যক্তি যে নিজের মধ্যে সহৃদয়তা, সহমর্মিতা, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ ইত্যাদিকে বিকশিত করবে, তা কিন্তু মোটেই সম্ভব নয়। উন্নতি এবং এ সকল মানবিক বিবেচনা মোটেই একসঙ্গে যায় না। উন্নতির সিঁড়ি ভাঙতে গেলে অবশ্য এ ধরনের সব রকম বোঝাকে সবেগে নিচে নিক্ষেপ করতে হয়। নইলে পদে পদে আশঙ্কা থাকে কাত কিংবা চিৎ হয়ে পড়ে যাওয়ার। মানবিক গুণাবলির চাঙারি কাঁধে বহন করে মস্ত বড় হয়েছে এমন কাহিনী এ যুগে রূপকথাতেও পাওয়া যায় না।

উন্নতির এই দর্শন নতুন কোনো বস্তু নয়। ব্রিটিশ যুগে এটি কার্যকর ছিল, পাকিস্তানি জমানায় বদলায়নি, স্বাধীন বাংলাদেশে একেবারে লকলক করে বেড়ে উঠেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল তখন প্রস্তাবনা ছিল এই রকমের যে, একটা শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করলেই চলবে, সেই শ্রেণির কাছ থেকে শিক্ষা নিচের দিকে চুইয়ে চুইয়ে পড়তে থাকবে। এমনকি বিদ্যাসাগরের মতো শিক্ষা-অন্ত মহাপ্রাণ মানুষও শিক্ষার এই দর্শনে সাড়া দিয়েছিলেন। বহু লোককে নিম্নমানের শিক্ষা না দিয়ে অল্প লোককে ভালো শিক্ষা দিলে তাতে দেশের মঙ্গল হবে বলে তিনিও বিশ্বাস করতেন। কেননা তারও ভরসা ছিল যে, উৎকৃষ্ট শিক্ষায় যারা ধনী হবে তারা শিক্ষাবঞ্চিতদেরকে সযত্ন প্রচেষ্টায় সুশিক্ষিত করে তুলবে। প্রতিবাদ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি বলেছিলেন যে, শিক্ষা জল বা দুধ নয় যে, উপরে ঢাললে তা নিচে পৌঁছে যাবে। নিয়ম তো বরং এই যে, শিক্ষা যতোটুকু পাওয়া যাবে তা সুযোগপ্রাপ্তরাই নিজেদের দখলে নিয়ে নেবে এবং এমন ব্যবস্থা করবে যাতে বঞ্চিতরা বঞ্চিতই থাকে। বঞ্চিতদেরকে শিক্ষিত করতে যাবে তারা কোন দুঃখে? প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি করে নিজেদের প্রাপ্ত সুযোগকে খর্ব করার মতো মূর্খ তারা নিশ্চয়ই নয়। বাস্তবে এমনটাই দেখা গেছে এবং দেখা যাওয়াটাই স্বাভাবিক বটে।

শিক্ষার ব্যাপারে যা ঘটেছে উন্নতির ব্যাপারেও অবিকল সেটাই ঘটেছে। উন্নতরা তাদের প্রয়োজনে চাকরবাকর, পাহারাদার, দোকানদার এসব ধরনের চাকরি তৈরি করে। লোক খাটায়, কিন্তু লোকের সঙ্গে নিজেদের উন্নতি ভাগাভাগি করে নেবে এমনটা কখনোই হতে দেয় না। আর এই যে উন্নতি এর ফলে গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান নেই, সেখানে অভাব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গ্রামে নদী যেমন শুকিয়েছে তেমনি শুকিয়েছে উন্নতির সম্ভাবনা। জীবিকা অর্জনের সুযোগ নেই বলেই মানুষ শহরে ছোটে। শহর তাদেরকে টানে, গ্রাম তাদেরকে ঠেলে বের করে দেয়। সমস্তটাই ঘটে উন্নতির মারাত্মক কারণে!

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
Preparing for Ramadan's Price Shocks

Power price to go up 4 times a year

The government has drawn up a plan to increase the price of electricity four times a year for the next three years to withdraw all subsidies in the power sector, which the IMF recommends.

1h ago