তেঁতুলতলা মাঠ: থানা হাজতে যেভাবে কেটেছে প্রিয়াংশুর ১৩ ঘণ্টা

‘২৪ এপ্রিল, রোববার। সেহরি শেষ করে ঘুমাতে একটু দেরি হয়েছিল। গভীর ঘুমে ছিলাম। রুমের দরজায় হঠাৎ বিকট শব্দ। ঘুমের ঘোরেই দরজা খুললে মামি বললেন, আম্মুকে থানায় তুলে নিয়ে গেছে।’
থানা হাজতে প্রিয়াংশু। ছবি: সংগৃহীত

'২৪ এপ্রিল, রোববার। সেহরি শেষ করে ঘুমাতে একটু দেরি হয়েছিল। গভীর ঘুমে ছিলাম। রুমের দরজায় হঠাৎ বিকট শব্দ। ঘুমের ঘোরেই দরজা খুললে মামি বললেন, আম্মুকে থানায় তুলে নিয়ে গেছে।'

'কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করবো। ওই অবস্থাতেই ফোনটা হাতে নিয়ে মাঠের দিকে দৌঁড় দেই। মাঠের কাছে গিয়ে বোনকে কল দেই। তাকে বলি, মাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে, কিছু একটা করো।'

'সেখানে অনেক পুলিশ দেখে বাসার দিকে ফিরছিলাম। কয়েকজন পুলিশ আমাকে ডাকতে থাকে। সাড়া না দিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম গলির মধ্যে ঢুকে গেলে আমাকে আর ধরতে পারবে না। এ সময় মাঠ থেকে ৫-৭ হাত দূরে থাকা মসজিদের সামনে এলে পুলিশ আমাকে ধরে ফেলে। সেখান থেকে তারা আমাকে মাঠে নিয়ে যায়। সেখানেই শুরু হয় পুলিশের দুর্ব্যবহার।'

এভাবেই সেই ১৩ ঘণ্টার কথা দ্য ডেইলি স্টারের কাছে বর্ণনা শুরু করেন ঢাকার তেঁতুলতলা খেলার মাঠ রক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমাজকর্মী সৈয়দা রত্নার ছেলে মোহাম্মদ ঈসা আব্দুল্লাহ (প্রিয়াংশু)।

গত রোববার সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে প্রিয়াংশুকে তুলে নিয়ে যায় কলাবাগান থানা পুলিশ। প্রিয়াংশুদের বাসা তেঁতুলতলা খেলার মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোনে। মাঠের ঠিক একটি ভবন পরেই তাদের ৩তলা বাসা। বাসার সামনেই আজ বুধবার প্রিয়াংশুর সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়।

জীবনের এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে ১৭ বছর বয়সী প্রিয়াংশু বলেন, 'মাঠে নিয়ে এক পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি এখানে কেন এসেছ? পাশে থেকে আসাদ নামের এক পুলিশ বলেন, "এই ছেলেটা চরম বেয়াদব।" আমার হাতে মোবাইল ছিল। পুলিশ সেটি কেড়ে নেয়। এ সময় দেখি আমার বোন ফোন দিয়েছেন। পরে আমি আবার ফোনটি নিয়ে আপুকে ২ মিনিটে বিষয়টি জানাই। কথা শেষ হলে পুলিশ আবার ফোনটি কেড়ে নিয়ে আমাকে বলে, "তুমি একটা চরম বেয়াদব।" তারপর তারা ফোনটি বন্ধ করে দেয়।'

পুলিশ তাকে হাতকড়া পরাতে চেয়েছিল উল্লেখ করে প্রিয়াংশু বলেন, 'তারা যখন হাতকড়া পরাতে চায় তখন আমি প্রতিবাদ করি এবং বলি যে, আমার কী দোষ, আমাকে কেন হাতকড়া পরাবেন? হাতকড়া আর পরায়নি। পরে আমাকে মাঝখানে রেখে ২ পাশে পুলিশ দাঁড়িয়ে আসামির মতো করে ছবি তোলে। তারপর পুলিশের ভ্যানে তোলা হয়। ভ্যানে পুলিশ বলে, "পুঁটি মাছের মতো লাফাতে হয় না। পুঁটি মাছ বেশি লাফালে জালে ফেঁসে যায়।'"

থানায় নিজের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে প্রিয়াংশু বলেন, 'থানায় আমাকে একটি হাজতে নেওয়া হয়। পরে আম্মুকে দেখতে পেয়ে আমি ডাক দেই। আম্মুর কষ্ট হচ্ছিল তাই আমার সামনের একটি হাজতে আম্মুকে আনা হয়। ওখানেও আম্মুর কষ্ট হচ্ছিল, তাই তাকে আরেকটি হাজতে নেওয়া হয়। শুরুর ৫ মিনিট আমি আম্মুকে দেখেছি। পরবর্তী ১৩ ঘণ্টা আর তাকে দেখতে পাইনি। বোনের সঙ্গে ৮ ঘণ্টায় আমার ২ বার দেখা হয়েছে। ১৩ ঘণ্টায় বোনের সঙ্গে আম্মুর একবারও দেখা হয়নি।'

থানার হাজতখানা থাকার অনুপযোগী উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেটা মানুষ থাকার মতো না। অনেক নোংরা। অনেক পোকামাকড় ছিল ওখানে। বিশেষ করে ওয়াশরুম এতটাই নোংরা ছিল যে, ১৩ ঘণ্টায় আমি একবারের জন্য ওয়াশরুম ব্যবহার করতে পারিনি। হাজতের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, অনেক কষ্ট হয়েছে।'

প্রিয়াংশুর পরিবারে মা ও বোন আছেন। তার বাবা ২০১৩ সালে মারা গেছেন।

১৩ ঘণ্টা হতাশা আর শঙ্কার মধ্যেই কেটেছে উল্লেখ করে প্রিয়াংশু বলেন, 'এই ১৩ ঘণ্টা আমাকে পুরো একা থাকতে হয়েছে। নিজেকে নিয়ে তেমন একটা চিন্তা না হলেও আম্মুকে নিয়ে খুব চিন্তা ও ভয় হচ্ছিল। কারণ আম্মুর কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আর যেন কাউকে না হতে হয়। এই বাজে অভিজ্ঞতা আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না।'

মাঠের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা তুলে ধরে এই কিশোর বলেন, 'আমি ১০ বছর ধরে এই মাঠে খেলি। আমার মা-বোন এই মাঠে খেলাধুলা করে বড় হয়েছেন। এলাকার সব শিশু এখানে ফুটবল, ক্রিকেট, কানামাছি, চোর-পুলিশসহ বিভিন্ন খেলা খেলে। মাঠটি এলাকার সবার জন্য সেতুবন্ধনের, মিলিত হওয়ার একটা জায়গা। ছোটবেলা থেকেই এই মাঠে ঈদের নামাজ পড়ি। কেউ মারা গেলে এখানে গোসল করিয়ে জানাজা হয়। এতকিছু হয়ে গেল, তারপরেও যদি মাঠটি দখল হয়ে যায় তাহলে আর কিছুই বলার নেই আমার।'

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

9h ago