মেহেদির ইতিহাস, প্রচলন ও ব্যবহার
মেহেদির নাম শুনলেই একটা উৎসব উৎসব গন্ধ পাওয়া যায়। মেহেদি দিয়ে হাত রাঙানো ছাড়া কোনো আনন্দ উদযাপনই যেন পরিপূর্ণতা পায় না। তাই সুপ্রাচীনকাল থেকে যেকোনো ধর্মীয় উৎসব থেকে শুরু করে পালাপার্বণ সবকিছুতেই রয়েছে মেহেদি পাতার একচ্ছত্র আধিপত্য।
মেহেদি পাতার ইতিহাস
সভ্যতার ইতিহাস ধরা হয় ৫ হাজার বছর। কিন্তু মেহেদির ইতিহাস তার চেয়েও পুরনো। নিওলিথিক বা নব্যপ্রস্তর যুগ (১০০০০-৪০০০ খ্রী.পূ.) থেকে মেহেদির প্রথম ব্যবহার দেখা যায় উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মরু অঞ্চলে। প্রায় ৯ হাজার বছর আগে মরুবাসীরা প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচার জন্য তাদের পা মেহেদি পেস্ট দিয়ে আচ্ছাদন করে রাখতো যা গোটা শরীরকে ঠাণ্ডা রাখতো। বিশেষত যোদ্ধাদের ভেতরে এর প্রচলন ছিল বেশি।
চিত্রকলার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ মার্কিন অধ্যাপক Dr. Marilyn Cvitanic-এর মতে, For over five thousand years henna has been a symbol of good luck, health and sensuality in the Arab world.
তাছাড়াও, দক্ষিণ চীনে প্রায় ৩ হাজার বছর ধরে প্রাচীন দেবী সংস্কৃতির সময় থেকে মেহেদি ব্যাপকভাবে প্রেমমূলক ধর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।
প্রাচীন মিশরের রাণী নেফারতিতি (খ্রী.পূর্ব ১৩৭০-১৩৩০) ও রানী ক্লিওপেট্রা (খ্রী.পূর্ব ৬৯-৩০) নিয়মিত মেহেদি ব্যবহার করতেন। মিসরের পিরামিডে ফারাও সম্রাটদের মমিতে মেহেদির ব্যবহার হতো। মধ্যযুগের কিছু চিত্রকলায় দেখা যায় কিং সলোমানের সঙ্গে রাণীর সেবারত অবস্থার কিছু ছবিতে তাকে মেহেদি পরতে দেখা যায়। ভারতের অজন্তা গুহাচিত্রেও অঙ্গসজ্জ্বায় মেহেদির ব্যবহার দেখা গেছে। উপমহাদেশে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে মেহেদির ব্যবহার শুরু হয় ও মুঘল আমলে প্রাকৃতিক প্রসাধনী হিসেবে মেহেদির ব্যপকতা ছড়িয়ে পরে। মোগল সম্রাট শাহজাহান পত্নি মমতাজকে মিশরের রাজা রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে মেহেদি ও মেহেদি চারা উপহার দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
এক হাজার ৫০০ বছর ধরে মুসলিম নারীরা মেহেদি ব্যবহার করে আসছে। নবীজি মুসলিম নারীদের হাতে মেহেদির নকশা করাকে উৎসাহিত করতেন। নবী কন্যা ফাতেমা (র) নিয়মিত হাতে মেহেদির ডিজাইন করতেন। নবীজী নিজেও তার দাড়িতে মেহেদি ব্যবহার করতেন। ইসলামী খেলাফতের সময় থেকে মুসলিম বিশ্বে মেহেদির ব্যবহার ধর্মীয় রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
মেহেদির বাহারি নাম
মেহেদি হিন্দি ও উর্দুতে মেহেন্দি, ইংরেজীতে হেনা (Henna), মধ্য-প্রাচ্যে হেন্না, মধ্য-এশিয়ায় 'আল-খান্না' নামে পরিচিত যা আরবী শব্দ আল-হিন্না (Al-Hinna) থেকে এসেছে। এর ইউনানী নাম হেনা, আয়ুর্বেদিক নাম মদয়ন্তিকা, বোটানিক্যাল নাম লসোনিয়া ইরামিস (Lawsonia Inermis) যা লেথরেসিয়া (Lythreaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
মেহেদির নানাবিধ ব্যবহার
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মেহেদির প্রচলন শুরু হলেও বর্তমানে মেহেদি দেওয়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথা হিসেবে পরিচয় লাভ করেছে । ইসলাম, খ্রিষ্টান, হিন্দু ,বৌদ্ধসহ প্রায় সকল ধর্মেই মেহেদির পবিত্রতা, ওষধি গুণাগুণ ও ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে ব্যাপক পরিমাণে মেহেদির ব্যবহার করা হয়।
আমাদের সমাজে মেহেদির ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বিয়ে, ঈদ-পূজা, বৈশাখ ও নববর্ষের অনুষ্ঠানে সময় ধারণা করা যায়। দুনিয়ার বহু দেশে এটি উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রাক বিবাহ, বিবাহ, গর্ভাবস্থার আটমাস, সন্তান জন্মের ৪০ দিন, সন্তানের নামকরণ প্রভৃতি পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আবহমানকাল থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে মেহেদির ব্যবহার হয়ে থাকে। আফ্রিকার অনেক জায়গায় আরোগ্য মুক্তি উপলক্ষে এবং আরব্য সংস্কৃতির বিয়েতে 'মেহেদি সন্ধ্যা' একটি জনপ্রিয় প্রথা রয়েছে যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহেও দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী ও বিভিন্ন প্রকার অর্গানিক চিকিৎসায় মেহেদির ব্যবহার হয়ে থাকে।
মেহেদির ডিজাইন
মেহেদির ডিজাইনে যুগে যুগে পরিবর্তন এসেছে ঠিকই কিন্তু সুন্দর কারুকার্য শোভিত ডিজাইনের আবেদন কখনোই কমে যায়নি। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই মেহেদি পরতে পারে তবে ডিজাইনে ভিন্নতা থাকা আবশ্যক। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রিষ্টান, শিখসহ বিভিন্ন ধর্মে ঐতিহাসিকভাবে মেহেদি পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যুক্ত। পৃথিবীর নানা জাতি ও অধিকাংশ আদিবাসী সমাজে সুস্বাস্থ্য, উর্বরতা, জ্ঞান, সুরক্ষা এবং আধ্যাত্মিকতার জ্ঞান হিসেবে প্রতিটি সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ডিজাইনের আলাদা অর্থ রয়েছে।
আফ্রিকান ডিজাইন
আফ্রিকান ডিজাইনে তাদের লোকজ, বন্য-সাহসী সংস্কৃতির প্রতিরূপ ফুটে উঠে। তাদের অধিকাংশ ডিজাইনগুলো জ্যামিতিক আকারে মোটা দাগে করা হয়। হাত-পা ছাড়াও মুখমণ্ডলসহ শরীরের যে কোন স্থানে তারা ডিজাইন করে।
আরবীয় ডিজাইন
আরবীয় কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সংক্ষিপ্ত সরল ডিজাইনের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। মুসলিম নারী পুরুষ নির্বিশেষে আরবী ক্যালিগ্রাফিক ডিজাইন পছন্দ করে। লতাপাতাসহ ফ্লোরাল ডিজাইন নারীদের প্রথম পছন্দ। ওই দেশগুলোতে গোটা হাত কিংবা শরীরে ভরাট ও বড় আকৃতির ডিজাইনের প্রচলন কম। তবে এবস্ট্রাক্ট লাইন ডিজাইনের প্রচলন রয়েছে।
ভারতীয় ডিজাইন
ভারতীয় উপমহাদেশে মেয়েরা ভরাট, দীর্ঘ, কারুকার্যময় জটিল ডিজাইন পছন্দ করেন। বিশেষ করে বিয়েতে কন্যার বাহুর গোড়া থেকে আঙুলের নখ পর্যন্ত ধারাবাহিক গল্পের মত ডিজাইনের প্রচলন দেখা যায়। নানা রঙের মেহেদির সঙ্গে গ্লিটার ও স্টোনের ব্যবহার লক্ষণীয়। নানা রকম কালার শেড ও ডট ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।
বাজারে প্রচলিত মেহেদি
আগে মেহেদি পাতা বেটে তা হাত-পায়ের নখ, হাতের তালুতে লাগানো হতো। মেহেদি বাটার ব্যবহার এখনো বেশ জনপ্রিয়। তবে বর্তমানে টিউব মেহেদির প্রচলন বেড়ে যাওয়ায় মানুষ কেনা মেহেদীতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বাজারে দুই ধরনের মেহেদি পাওয়া যায়। একটি হলো তৈরি করা বা ইনস্ট্যান্ট মেহেদিতে ৫ থেকে ১০ মিনিটে রং আসে কিন্তু প্রতি ধোয়াতে হাত থেকে রং কমতে থাকে। আরেকটি হলো প্রাকৃতিক বা অরগানিক মেহেদি। যেকোনো উৎসবে অরগানিক মেহেদি ব্যবহার করা ত্বকের জন্য ভালো। কারণ, এই মেহেদি হাতে তৈরি, তাই এতে রাসায়নিকের ব্যবহার থাকে না। এর রং হয় গাঢ়, দীর্ঘস্থায়ী এবং ত্বকের জন্য ক্ষতিকর নয়।
তথ্যসূত্র
১. "History, Origin & Cultural Significance of Henna".
২. "Para-phenylenediamine Allergy: Current Perspectives on Diagnosis and Management."
৩. 'Encyclopedia of Hair: A Cultural HistoryHistory.'
Comments