নগরজুড়ে কৃষ্ণচূড়ার রঙমশাল

আগুনঝরা কৃষ্ণচূড়া। সংসদ ভবন এলাকা থেকে তোলা। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

শিমুল-পলাশ ফোটা ঋতুরাজ বসন্তের দিন পেরিয়েছে। এখন গ্রীষ্মের পুষ্প উৎসবে এই ধূসর নগরের ভাঁজে ভাঁজে ডানা মেলেছে আগুনঝরা পুষ্পবৃক্ষ কৃষ্ণচূড়া।   

গ্রীষ্মের এই পুস্প উৎসবে ধুলা-দূষণের এই 'শূন্যগর্ভা' মহানগরের সীমিত উদ্যান, পার্ক ও প্রধান সড়কগুলোর দুই পাশে দেখা মিলছে মনোহর জারুল, স্বর্ণাভ সোনালু, মধুমঞ্জরী, নীলাভ জ্যাকারান্ডা ও কাঠগোলাপের মতো পরিচিত-অপরিচিত সব ফুল। তবে দূরভেদী কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম উদ্ভাসের কাছে ম্লান হয়ে গেছে সব রঙ।

জাতীয় সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেক সংলগ্ন সড়কটি এখন কৃষ্ণচূড়ার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। ছবি: স্টার

বরাবরের মতো ঈদের ছুটিতে ইট-কাঠের এ নগর থেকে 'ঝাঁকবাধা সারসের মতো' উড়ে গেছে মানুষের অগণিত মাথা। সেই অবকাশে আপাত যানজটহীন এই শহরে থেকে যাওয়া বাসিন্দাদের মনে লাবণ্যের স্পর্শ এনে দিচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার আগুনে সৌন্দর্য।

ঢাকার পথে পথে রক্তলাল এই ফুল নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাসের সীমা নেই। কেউ কেউ বেড়াতে গিয়ে এই ফুলের ছবির সঙ্গে পছন্দসই পদ্যের দু-চারটি চরণ জুড়ে দিচ্ছেন ফেসবুকের পাতায়। আবার কারও কারও ফেসবুকের দেয়াল ভরে উঠতে দেখা যাচ্ছে গাছতলা ছেয়ে থাকা ঝরা ফুল ও সবুজ পাতার ঐশ্বর্যে।

রাজধানীর বুকে কৃষ্ণচূড়ার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হলো জাতীয় সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেক সংলগ্ন সড়কটি। এর ওপারে চন্দ্রিমা উদ্যানের ভেতরের অনেক গাছেও আছে ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া। শেরেবাংলা নগরেও এখানে-ওখানে কৃষ্ণচূড়ার আধিক্য চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্ত্বর কৃষ্ণচূড়ার আরেক জগত। তা বাদে কলাভবনের সামনে বিশেষ করে গুরুদুয়ারা নানকশাহীর পেছনের গাছগুলোতে এ বছর ফুলের প্রাধান্য বেশি চোখে পড়ছে।

ছবি: স্টার

কাছাকাছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনা কালি মন্দিরের আশপাশের গাছগুলোতেও আছে আগুনঝরা কৃষ্ণচূড়ার আধিক্য। রমনা পার্কের অস্তাচল গেট, ওসমানী উদ্যানের নগরভবনের সামনের দিকের প্রবেশপথেও আছে মনোহর এই ফুল।

ঢাকায় এ ফুলের আরেক জগত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন নামে পরিচিত মিরপুরের এ উদ্যানের ভেতরের গাছগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া। এছাড়াও ঢাকার ওয়ারী এলাকার বলধা গার্ডেন, পুরানো ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্কেও ফুটেছে এই ফুল।

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের কাছে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের সামনেও ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া দেখা মিলবে। আর হলুদ কৃষ্ণচূড়া দেখা যাবে হেয়ার রোড, সংসদ ভবনের পূর্ব পাশের সড়ক ও ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ভেতরে।

শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে কৃষ্ণচূড়ার শোভা। ছবি: স্টার

সবখানেই ছাতার মতো মেলে থাকা কৃষ্ণচূড়ার ডালপালাজুড়ে এখন অগুনতি ফুলের অবারিত উচ্ছ্বাস। শাখাগুলো দেখাচ্ছে একেকটি সুবিন্যস্ত পুষ্পস্তবকের মতো।

মনোলোভা এই ফুল নিয়ে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ একবার লিখেছিলেন, 'আমি কৃষ্ণচূড়াকে প্রেম ভেবে/কোনো এক বসন্তের রাতে/গোপনে বুকে রেখেছিলাম/তখন বসন্ত ছিলো/আমার কোকিল ছিলো।'

কিন্তু দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত নিসর্গ, নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা গ্রন্থে নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা বলছেন, 'বসন্তে কৃষ্ণচূড়া ফোটে না। আর ফুলের বাজারে কিন্তু কৃষ্ণচূড়া বিকোয় না।'

দ্বিজেন শর্মা তার আরেক রচনায় জানাচ্ছেন, আফ্রিকার মাদাগাস্কার থেকে উনিশ শতকের প্রথম দিকে এই গাছ প্রথমে ইউরোপ, তারপর উপমহাদেশে আসে। সে হিসেবে বাংলা মুলুকে কৃষ্ণচূড়ার আবির্ভাবের বয়স ৩০০ বছরের মতো।

কৃষ্ণচূড়ার ঝরা ফুলের সৌন্দর্যও কম নয়। ছবি: স্টার

কৃষ্ণচূড়ার ফুল উজ্জ্বল লাল ও হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। পাপড়িগুলো প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়ার পাতা সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ২০ থেকে ৪০টি উপপত্রবিশিষ্ট। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া (Delonix regia), যা ফ্যাবেসি (Fabaceae) পরিবারের অন্তর্গত। ইংরেজিতে এটি পরিচিত ফ্লেম ট্রি (Flame Tree) হিসেবে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেও কৃষ্ণচূড়ার দর্শন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, 'গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী/কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।' আবার নজরুলও তার একটি গানে বলছেন, 'রেশমি চুড়ির তালে কৃষ্ণচূড়ার ডালে/পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা ডেকে ওঠে পাপিয়া।'

এ ছাড়া ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলকে 'উজ্জ্বল মনি'র সঙ্গে তুলনা করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ঈর্ষান্বিত হয়ে তিনি লিখেছেন, 'বসুধা নিজ কুন্তলে/পরেছিল কুতূহলে/এ উজ্জ্বল মণি,/রাগে তারে গালি দিয়া,/লয়েছি আমি কাড়িয়া—/মোর কৃষ্ণ-চূড়া কেনে পরিবে ধরণী?'

রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া। ছবি: স্টার

এদিকে ডালের পাশাপাশি গাছের নিচে পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার ঝরা ফুলের শোভাও কম নয়। তবে তা উপভোগের প্রকৃষ্ট সময় ভোরবেলা। কৃষ্ণচূড়ার এই ঝরা ফুল নিয়ে কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী মোহাম্মদ রফি গেয়েছিলেন, 'গুলমোহরের ফুল ঝরে যায়, বনে বনে শাখায় শাখায়/কেন যায় কেন যায়/বাহারের মন ভেঙে যায়...'।

পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কৃষ্ণচূড়া পরিচিত 'গুলমোহর' নামে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

7h ago