মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ সুবেদার ফয়েজ আহমদ, বীর উত্তম

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল শহীদ সুবেদার ফয়েজ আহমদ, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

সুবেদার ফয়েজ আহমদ সিলেটের এমসি কলেজ যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার সনদ নম্বর ২৯।

১৯৭১ সালে সুবেদার ফয়েজ আহমদ প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টে।  ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের আক্রমণ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলার জন্য ব্যাটেলিয়নের অর্ধেক সেনাকে ছুটিতে পাঠানো হয়। বাকিদের বেনাপোল সীমান্ত এলাকার জগদীশপুর গ্রামে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। এ সময় রেডিও শোনা নিষিদ্ধ থাকায় ২৫ মার্চ কালরাতে হানাদারদের গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারেননি বাঙালি সেনারা। পরে ২৯ মার্চ ১০৭ নম্বর ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দূরদানি প্রশিক্ষণরত সেনাদের যশোর ক্যান্টনমেন্টে ফিরতে বললে তারা রাতের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যান।

৩০ মার্চ ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করা হলে বাঙালি সেনারা  অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে পজিশন নেন।  ২৫ বেলুচ রেজিমেন্ট ও ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অবাঙালি সেনারা বাঙালি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালালে মধ্যরাতে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে সুবেদার ফয়েজ আহমদসহ বাঙালি সেনারা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

৩১ মার্চ সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালালে বেশ কয়েকজন বাঙালি সেনা শহীদ হন। গোলাগুলি কমে আসলে ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ক্যান্টনমেন্ট থেকে কাভারিং ফাইটের সাহায্যে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে যান সুবেদার ফয়েজ আহমদসহ বাঙালি সেনারা। এরপর তারা চৌগাছা বাজারে গিয়ে একসঙ্গে হন। চৌগাছা যশোর সড়কের উপর সলুয়া বাজারে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন সুবেদার ফয়েজ আহমদ।

পরে যশোর ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন গ্রামগুলোতে সুবেদার ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বে তার প্লাটুনের হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৪ এপ্রিল তার নেতৃত্বে কাগজপুকুরে অবস্থান নিয়েছিলেন ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গলের ৫০০ সেনা।

২৩ এপ্রিল কাগজপুকুর যুদ্ধের পর ভারতে চলে যান সুবেদার ফয়েজ আহমদ ও তার অধীনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা। পরে  মে মাসের মাঝামাঝিতে ক্যাপ্টেন হাফিজকে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাটেলিয়ন তৈরি করা হয় এবং মে মাসের শেষ সপ্তাহে সুবেদার ফয়েজ আহমদ পুরো ব্যাটেলিয়ন নিয়ে চলে যান মেঘালয়ের তুরায়।

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জেড ফোর্সের হেডকোয়ার্টার সরিয়ে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দিয়ে সিলেটের চা বাগানগুলোতে আক্রমণ চালানো হয়।  সুবেদার ফয়েজ আহমদ প্রথম অভিযান চালান কেজুরিছড়া চা বাগানে। ১৫ অক্টোবর  সিলেটের ফুলতলা সাগরনাল চা বাগান রেইড,  ২৮ অক্টোবরের ধলই বিওপি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। নভেম্বরে আটগ্রাম- চারখাই- সিলেট ধরে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আটগ্রাম ও চারগ্রাম দখল করেন সুবেদার ফয়েজ আহমেদসহ মুক্তিযোদ্ধারা।

৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে সিলেট দখলের পরিকল্পনা করা হয়। তখন পাকিস্তানি বাহিনী দরবস্ত ও খাদিমনগর এলাকায় অবস্থান নিলে সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিবাহিনী কানাইঘাট- চরখাই হয়ে সিলেট দরবস্ত সড়কে উঠবে। এরপর টানা ৩ দিন পায়ে হেঁটে ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে সিলেটের এমসি কলেজের উত্তর পাশে হানাদারদের শক্ত ঘাঁটির ৫০০ গজ দূরত্বের মধ্যে পৌঁছায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানি। 

এ সময় ব্রাভো কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলেন সুবেদার ফয়েজ আহমদ। তার পেছনে ছিল ক্যাপ্টেন নূরের আলফা ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীর ডেল্টা কোম্পানি। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করলে ২৫ পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। পাকিস্তানিরা পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করে তাদের মরদেহগুলো সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে ব্রাভো কোম্পানি আক্রমণের তীব্রতা বাড়ায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের মর্টারের গোলা শেষ হয়ে যায়। তবুও সুবেদার ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বে তার প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা মেশিনগান, হালকা মেশিনগান ও রাইফেলের সাহায্যে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।

দুপুরের পর পাকিস্তানিরা ব্রাভো কোম্পানির ওপর সর্বশক্তি দিয়ে হামলা চালানো শুরু করে। এক পর্যায়ে একটি গোলা এসে লাগে সুবেদার ফয়েজ আহমদের গায়ে। শহীদ হন সুবেদার ফয়েজ আহমদ, বীর উত্তম।

সুবেদার ফয়েজ আহমদের জন্ম ১৯৪০ সালে ফেনীর পরশুরাম উপজেলার অলকা গ্রামে। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষে ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস

 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
National Consensus Commission Holds Talks with BNP, Jamaat, and NCP

Parties split over ‘pluralism’, nat’l constitutional council

The National Consensus Commission’s talks with major political parties have yielded a broad consensus on key issues such as caretaker government system and a bicameral parliament, but the parties remain divided on some sensitive questions.

11h ago