পাবনায় এ বছর ৫০০ কোটি টাকার লিচু বাণিজ্যের সম্ভাবনা

ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

বছরের এই সময়টায় সবাই মৌসুমি রসালো ফলগুলোর অপেক্ষায় থাকে। এর মধ্যে লিচু যে সামনের সারিতে আছে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ খুব সামান্যই। সারা দেশে লিচুর চাহিদার কারণে পাবনায় গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছে লিচুর চাষ।

গত কয়েক বছর ধরে পাবনার লিচু চাষিরা আশানুরূপ লাভ না পেলেও এ বছর লিচুর বাম্পার ফলনে আশায় বুক বেঁধেছে তারা। কৃষি বিভাগের আশা, এ বছর পাবনায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার লিচুর ব্যবসা হবে।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য মতে, পাবনা জেলার লিচু বাগানগুলোর আয়তন এ বছর ৪ হাজার ৭৩১ হেক্টরে গিয়ে ঠেকেছে। এসব বাগান থেকে ৪২ হাজার ৫৭৯ মেট্রিক টন লিচু পাওয়া যেতে পারে।

ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক মো. মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর লিচুর ফলন উপযোগী আবহাওয়ার পাশাপাশি গ্রীষ্মের শুরুতে বড় আকারে ঝড়-বৃষ্টি না হওয়ায় এ বছর লিচুর বাম্পার ফলন পাওয়া যাবে।'

এর মধ্যে আটি জাতের লিচু সংগ্রহ শুরু হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে অন্যান্য জাতের লিচুও পাবনার বাজারে ব্যাপকভাবে পাওয়া যাবে। ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায় গাছ থেকে লিচু আহরণ, বাছাই এবং প্যাকেট করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

ঈশ্বরদীর সিলিমপুর গ্রামের লিচু চাষি মো. সনজু প্রামাণিক ডেইলি স্টারকে জানান, তার নিজের একটি লিচু বাগান আছে। এ বছর আরও পাঁচটি বাগান ইজারা নিয়েছেন। প্রতিটি গাছ থেকেই এবার ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে।

সনজু বলেন, গত বছর একটি মাঝারি আকারের গাছ থেকে ৮ থেকে ১০ হাজারের বেশি লিচু পাওয়া যায়নি। একই আকারের গাছ থেকে এ বছর ১২ থেকে ১৫ হাজার লিচু পাওয়া যাচ্ছে।

তবে ফলন ভালো পেলেও বাজারে লিচুর দাম কম হওয়ায় আশানুরূপ লাভ হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

সনজু বলেন, 'গত বছর প্রতি হাজার লিচু ২২০০ থেকে ২৩০০ টাকায় বিক্রি করলেও এ বছর ১২০০ থেক ১৫০০ টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।' তবে, ফলন ভালো হওয়ায় দাম নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন তিনি।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্ষণস্থায়ী ফলনের জন্য লিচুর প্রতি সবার আগ্রহ থাকে, আর পাবনায় গ্রীষ্মের শুরু থেকেই লিচু পাকতে শুরু করে। বিভিন্ন জাতের লিচু পাওয়া যায় গ্রীষ্মের শেষ পর্যন্ত।'

একসময় শুধু আটি লিচুর উৎপাদন হলেও, চাহিদা বাড়ায় এখন পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলে চায়না-৩ এবং বোম্বাই লিচুর চাষ অনেক বেড়েছে। এতে করে লিচু চাষিরা বাণিজ্যিকভাবে সফল হচ্ছেন।

মৌসুমি ব্যবসায় বেশি লাভ আর কর্মসংস্থানের সুযোগ

বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লিচু নিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ব্যবসার বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

পাবনার সাহাপুর গ্রামের তরকারির ব্যবসায়ী মিরাজুল ইসলামের নিজের কোন বাগান নেই, তবে তার এলাকায় প্রায় অধিকাংশ বাড়িতেই রয়েছে লিচু গাছ। মৌসুমের শুরুতে দুটি বাগান কিনে লিচুর ব্যবসা শুরু করেন তিনি।

প্রায় দুই লাখ টাকা দিয়ে ৫০ টি গাছের দুটি বাগান কিনে পরিচর্যা শুরু করেন মিরাজুল। সার, কীটনাশক ও শ্রমিক খরচ মিলিয়ে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকা।

তার বাগানের প্রতিটি গাছ থেকে ১২ থেকে ১৫ হাজার লিচুর ফলন পাওয়া যাচ্ছে। তিনি জানান, বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে দুটি বাগান থেকে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকার লিচু পাওয়া যাবে। মাত্র দুই থেকে আড়াই মাসের পরিশ্রমে লিচুর ব্যবসা থেকে ভালো লাভ পাওয়া সম্ভব।

তার মতো অনেকেই মৌসুমি লিচু ব্যবসা করে লাভবান হয়েছে বলে জানান তিনি।

ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

শুধু মৌসুমি ব্যবসায়ী নয়, লিচু বাগান থেকে লিচু সংগ্রহ, বাছাই করা, প্যাকেট করাসহ এক মণ লিচু প্রক্রিয়া করতে দুই জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। লিচু সংগ্রহ শুরু হওয়ায় অনেকেই লেখাপড়া বা সংসারের কাজের পাশাপাশি লিচু বাগানে শ্রম দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করার সুযোগ পেয়েছেন।

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার তিলকপুর গ্রামের কলেজ ছাত্র আলিফ, লিচুর মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি লিচু বাগানে কাজ করছেন। তার মতো অনেকেই বাগানে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

আলিফ জানান, সকালে কয়েক ঘণ্টা লিচু বাগানে কাজ করেই ৫০০ টাকা আয় করা সম্ভব, লিচুর মৌসুমে বিপুল সংখ্যক মৌসুমি শ্রমিক প্রয়োজন হওয়ায় তার মত অনেকেই লিচু বাগানে কাজ করে অতিরিক্ত আয় করছে।

লিচুর ব্যবসা পাবনার কৃষি অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখলেও এখনও পাবনায় লিচুর বাজার গড়ে না উঠায় লিচু চাষিদের ফড়িয়া, মধ্যসত্বভোগী ও মহাজনদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

কৃষকদের স্বার্থে ওসাকা নামে পাবনার একটি বেসরকারি সংস্থা ইতিমধ্যে লিচুর জন্য বিশেষ বাজার গড়ে তোলার কাজ হাতে নিয়েছে।

ওসাকার পরিচালক মো. মাজাহার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইতোমধ্যে ঈশ্বরদী উপজেলার ভারইমারি গ্রামে লিচুর জন্য একটি বাজার গড়ে তোলার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে এসে লিচু কিনতে পারবেন। এই মৌসুমেই বাজারটি চালু হবে।'

এছাড়াও ঈশ্বরদীতে কয়েকটি লিচু বাগানকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

Comments