পাঠের সংস্কৃতির চেয়ে পথের সংস্কৃতি তরুণদের বিপথগামী করছে

প্রতীকী ছবি

৬ মাসের বাচ্চাকে ৬ বছর পরে দেখলে পার্থক্যটা সহজেই ধরা যায়। এবারের ঈদ স্মৃতিতে একযুগ আগের বদলে যাওয়া আঞ্চলিক সংস্কৃতি চোখে ধরা পড়েছে ঠিক সেরকমই। হাত বাড়ালেই মাদকের ছোঁয়া এখন ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। মাদক সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী এলাকার সাধারণ মানুষ। কিশোর-তরুণরা মারাত্মকভাবে মাদকের বলি হচ্ছে। এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কিশোর গ্যাংদের দৌরাত্ম্য এতো বেশি ছড়িয়ে পড়ছে যে, মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা পর্যন্ত হিমশিম খাচ্ছেন এ পেশায় দায়িত্ব পালনে।

পর্নোগ্রাফি আর অবাধ মাদকের ছোবলে কিশোর গ্যাংদের দাপটে ধরাশায়ী হয়ে গেছে এলাকার চিরায়ত সংস্কৃতি। বয়োজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহের সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে এলাকা থেকে। সবাই যেন সবার কাছে অপরিচিত। এক অদেখা অভেদ্য দেওয়ালে প্রত্যেকেই বন্দী হয়ে আছে। ভালো পরিবেশ, পাঠের প্রতিযোগিতা ও সুস্থ বিনোদনের সংস্কৃতি ও তার বিকাশ না থাকায় কিশোররা বাধ্য হয়েই নিজেদের অজান্তে জড়িয়ে পড়ছে এক ভয়ংকর জগতে। এর ফলাফলও নিজ চোখে দেখলাম। অল্প বয়সী তরুণ, যাদের ছোটবেলা থেকে চিনতাম শ্রম ও কর্মমুখী মানুষ হিসেবে, নেশা তাদের ঘর ভেঙেছে। হিংস্র করেছে কাউকে, কেউ আবার পাগল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এমন সংখ্যা একাধিক।

এলাকার সুশীল সমাজকে যে কর্ম-ভূমিকায় ছেলেবেলায় হাজির হতে দেখতাম, এখন সেই প্লাটফর্মটিও শূন্য। লাইব্রেরি কিংবা পাঠের কোনো সংস্কৃতির প্রভাব না থাকায়, শিক্ষার্থী বান্ধব শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে উপযুক্ত প্লাটফর্মে নিজেকে হিরো করার প্রতিযোগিতা কিংবা উৎসাহের পরিবেশ না পাওয়ায় কিশোর-তরুণরা নিজেদের জানান দিতে, শৌর্য, বীর্যের অবস্থা জানাতে রাস্তা-ঘাটে পথে-প্রান্তে মানুষকে মারধর, হয়রানি, নেশা, ইভটিজিং, কখনো বাইক যোগে দূরে গিয়ে জমিদখল, এলাকার দোকানপাট-প্রকল্প থেকে চাঁদাবাজি এবং সেই টাকায় ফুর্তি করার অপরাধকেই বেছে নিয়েছে।

এই অপসংস্কৃতি খুব দাপুটে অবস্থানেই আছে। আগে গাঁও-গেরামে পঞ্চায়েত তথা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের একটি গুরুত্ব ছিল অপরাধ দমনে। কিন্তু তাদেরও বেশ বিচ্ছিন্ন মনে হলো সমাজ থেকে। যে যার মতো জীবনকে যাপন করে যাচ্ছেন।     

শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মাল্টি অ্যাকসেস একাডেমির (মা) উদ্যোগে দক্ষিণাঞ্চলের কলাপাড়ায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে একসঙ্গে ইফতার ও তাদের বর্তমান শিক্ষা ক্যারিয়ার বিষয়ে জানতে জরিপের আয়োজন করেছিলাম। সেখানে শিক্ষার্থীদের কাছে ১০টি প্রশ্ন জানতে চাওয়া হয়। যে প্রশ্নগুলো ছিল- নিজ এলাকার বর্তমান সংকটগুলো কী কী, এর সমাধান বিষয়ে তাদের ভাবনা কী, কিশোরদের মানসিকভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার পেছনে কী কী প্রতিবন্ধকতা শিক্ষার্থীরা খুঁজে পেয়েছে, শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পত্রিকা পড়ে কি না, কত ঘণ্টা প্রতিদিন পাঠ্যবইয়ে ব্যয় করে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে ভিন্ন কোনো বই পড়ে কি না, ভাষাগত ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতা রোধে তারা কতটুকু সচেতন, তা শেখার পেছনে দৈনন্দিন কত ঘণ্টা ব্যয় করে, স্মার্টফোনে তারা কত ঘণ্টা সময় ব্যয় করে ও কী কী কন্টেন্ট দেখে, বাসায় পড়ার জন্য আলাদা রুম আছে কি না, বাড়ির ঘরোয়া লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা কেমন, মা-বাবা সন্তানদের নিয়মিত পড়াশোনা ও নৈতিক জ্ঞানার্জনের বিষয়ে কত ঘণ্টা সময় দেন, ভবিষ্যতে কোন পেশায় যেতে চায়, ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান আছে কি না, পড়ালেখার পাশাপাশি স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী হতে কোনো কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে কি না? জরিপে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী যারা ৬ষ্ঠ থেকে স্নাতক পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ও যারা ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে তারাও অংশগ্রহণ করে। 

অধিকাংশ শিক্ষার্থীই জানতে চাওয়া প্রশ্নগুলো দেখে হতবাক। যেন কখনো কেউ এ বিষয়ে ওদের কাছে জানতে চায়নি কিংবা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় তাকে কখনো চিন্তা করতে হয়নি। চিন্তা করা যেন উপস্থিত শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ বিরক্তিকর ও কঠিন হয়ে গেছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা তাদের দেখা সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে মাদক ও মোবাইলে অতিরিক্ত সময় ব্যয় ও ভার্চুয়াল জগতে সময় দেওয়াকে বেশি দায়ী করছে। জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশের বাসাতেই আলাদা পড়ার রুম ও ব্যক্তিগত লাইব্রেরি নেই, অধিকাংশই পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়ে না, পত্রিকা পড়ার অভ্যাসও কম। অপরদিকে দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছে যারা, তারা খুব বেশি শিক্ষামূলক কন্টেন্ট দেখছে না। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মা-বাবা সন্তানকে সময় দেন না বলেও জরিপে শিক্ষার্থীরা মতামত দিয়েছে। অপরদিকে যাদের বাসায় মা-বাবা সন্তানকে সময় দিচ্ছেন ও পারিবারিক লাইব্রেরি সমৃদ্ধ তারা লেখাপড়ায় এগিয়ে আছে। যে বাবা-মা সন্তানের পাঠের পরিবেশ দিয়েছেন এবং সে পরিবেশে বেড়ে উঠতে নিয়মিত সন্তানকে সময় দিচ্ছেন, তাদের সন্তানদের অবস্থানও বেশ ভালো বলে জরিপে উঠে উঠেছে।

জরিপের পুরো ফলাফল বিশ্লেষণে হয়ত আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসবে। তবে এটুকু দৃশ্যমান যে, একটা অঞ্চলে পাঠের পরিবেশ পরিবার ও সমাজে গড়ে না উঠলে একটা সময় শেষে শিক্ষিত ও মূর্খ মানুষের কর্ম এবং আচরণ সমান হয়ে যায়। একইসঙ্গে একটা সমাজের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষ যখন উভয়েই অধিক পরিমাণ খাওয়া, ভোগ, টাকা উপার্জন এবং অবাধ যৌনাচারে সম্পৃক্ত হতে বেশি আগ্রহী হয়ে যায়, তখন সে সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। এর প্রভাবে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী জীবনে ত্যাগের চেয়ে ভোগের মধ্যেই আরাম খুঁজে পায়। পাঠের সংস্কৃতির চেয়ে পথের সংস্কৃতিই সে সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে।

মুতাসিম বিল্লাহ: শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Exporters fear losses as India slaps new restrictions

Bangladesh’s exporters fear losses as India has barred the import of several products—including some jute items—through land ports, threatening crucial trade flows and millions of dollars in earnings.

5h ago