মাঙ্কিপক্স মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও করণীয়

ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বিশ্বের ১১টি দেশে প্রায় ৮০ জন মাঙ্কিপক্স রোগী শনাক্ত হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে জানিয়েছে, আরও রোগী পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে আরও সন্দেহভাজন ৫০ জনের বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

এর আগে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানায়, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে। মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাঙ্কিপক্স সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

আশার কথা হলো এশিয়ার কোনো দেশে এখনো মাঙ্কিপক্স রোগী পাওয়া যায়নি।

মাঙ্কিপক্স মোকাবিলায় বাংলাদেশের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, তা জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেনের সঙ্গে।

তারা মাঙ্কিপক্স ভাইরাস মোকাবিলায় সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সেই সঙ্গে কারও শরীরে বসন্ত রোগের উপসর্গ দেখা গেলে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। হাসপাতালগুলোকে রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানোর কথা বলেছেন। দেশের বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে ভালোভাবে পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'মাঙ্কিপক্সের জন্য বাংলাদেশে এখনো কোনো বিশেষ সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। আমদের সরকারও এই ভাইরাসটি সম্পর্কে এখনো কিছু বলছে না। মাঙ্কিপক্স নাক দিয়ে ঢোকে। এই ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে তার সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না। ভাইরাসটি মোকাবিলায় মাস্ক পরতে হবে, বারবার হাত ধুতে হবে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যেসব নিয়মকানুন মানা হয়, মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও একই ধরনের নিয়ম মানতে হবে। বিমানবন্দরগুলোতে কারো মধ্যে মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ দেখা দিলে তাকে অন্তত ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে।'

মাঙ্কিপক্সের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকলেও বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুটিবসন্তের টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে প্রায় ৮৫ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আমাদের দেশে গুটিবসন্তের টিকা আছে কি না, জানতে চাইলে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'বাংলাদেশে গুটিবসন্তের কোনো টিকা নেই। পৃথিবীতে গুটিবসন্ত এখন আর নেই। তাই এর টিকাও নেই। তবে, গবেষণার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১২টি ল্যাবে ছিল। এখন কয়টিতে আছে তা আমার জানা নেই। আমাদের দেশে ১৯৭৯ সালে নোয়াখালীর হাতিয়ায় রহিমা নামের ৮ বছরের এক গুটিবসন্তের রোগী পাওয়া যায়। এরপর আমাদের দেশে আর কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।'

মাঙ্কিপক্স সম্পর্কে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, 'মাঙ্কিপক্স থেকে সেরে উঠতে ২-৪ সপ্তাহ লাগে। ভাইরাসটি প্রতিরোধে যারা বাইরের দেশ থেকে বিশেষ করে যারা আফ্রিকার দেশ থেকে আসছেন, তাদের প্রতি নজর রাখতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে। এই ভাইরাসটি এখনো গবেষণা পর্যায়ে আছে। তাই বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।'

ড. মুশতাক হোসেন বলেন, 'বাংলাদেশে ভাইরাসটি চলে এসেছে কি না সেটি খোঁজার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। তবে, চিকেনপক্স (জলবসন্ত) কোনো রোগী পাওয়া গেলে আইইডিসিআর বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খবর দিতে হবে। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এগুলো চালিয়ে যেতে হবে। এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। তবে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। মাঙ্কিপক্সের সরাসরি কোনো চিকিৎসা নেই। কেউ আক্রান্ত হলে তাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। তার সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে এই রোগী পাওয়া গেলে তারপর ব্যাপক প্রচারে যেতে হবে।'

তিনি বলেন, 'বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস থাকে। দেশে যারা প্রাণীসম্পদ বিজ্ঞানী, তাদেরকে এটি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করতে হবে। আইইডিসিআর মানুষ নিয়ে কাজ করবে আর প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর প্রাণী নিয়ে কাজ করবে। প্রথম থেকে ধরতে পারলে দ্রুত মানুষকে সচেতন করা যাবে।'

মাঙ্কিপক্সের জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিভিন্ন হাসপাতালে চিঠি দিতে হবে যে, চিকেনপক্স হলেই যেন নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। আগে যারা প্রাণী শিকার করত বা চিড়িয়াখানায় কাজ করত তাদের মাঙ্কিপক্স হতো। মানুষ থেকে এই রোগ ছড়াত না। এখন নতুন করে এটি মানুষের মধ্য দিয়ে ছড়াচ্ছে। তাই সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করা হয়। তাই এখনো এটির জন্য আলাদাভাবে কিছু করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ এই ভাইরাসের লক্ষণ হলো জ্বর। বাইরে থেকে কেউ আসলে বিমানবন্দরে অবশ্যই তার জ্বর ধরা পড়বে। তখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। কেউ ত্বকে ফুসকুড়ি নিয়ে আসলে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে বিমানবন্দরগুলোতে আলাদা করে ব্যবস্থা নিতে হবে।'

গুটিবসন্তের টিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'যারা যৌক্তিক বা অযৌক্তিকভাবে গুটিবসন্তের ভাইরাসকে টিকিয়ে রেখেছে, শুধু তাদের কাছেই টিকা আছে। মূলত কেউ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে সেই পরিবারের সদস্যদের এবং যারা রোগীর সংস্পর্শে আসবে তাদেরকে এই টিকা দেওয়া যেতে পারে। মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের টিকাও কিন্তু আবিষ্কার করা আছে। সেটা প্রাণীর দেহে প্রয়োগ করে সফলতা পাওয়া গেছে। মানুষের দেহে এই টিকা দেওয়া হলে ফিজিক্যাল ট্রায়াল হিসেবেই দিতে হবে। আফ্রিকায় প্রতি বছর বিশেষ করে যারা বনে শিকার করেন তাদের এই রোগ হয়। তবে, তেমন একটা আলোচনায় আসে না।'

Comments