বাঙালির নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায় ও তার সংবাদপত্রের ভূমিকা

বাঙালির শিক্ষা, সমাজ সংস্কার, বিজ্ঞানমুখী সমাজ ব্যবস্থা, বর্ণ-শ্রেণি-জাতিগত ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা—কোথায় নেই রাজা রামমোহন রায়ের অবদান? তার মাধ্যমেই মধ্যযুগের ভারতে হলো বিপ্লব। অচলায়তন ভেঙে তিনি এনে দিলেন আলোর দুয়ার। সংস্কার, সামাজিক পুনর্গঠন ও আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা অনেক। তার এসব ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয় সবসময়ই। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র এবং সংবাদপত্রে তার পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি কেন যেন একটু আড়ালে পড়ে থাকে। অথচ সংবাদপত্রের মাধ্যমেই সমাজ পুনর্গঠন ও রেনেসাঁর ক্ষেত্রে অতুলনীয় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।
রাজা রামমোহন রায়। সংগৃহীত

বাঙালির শিক্ষা, সমাজ সংস্কার, বিজ্ঞানমুখী সমাজ ব্যবস্থা, বর্ণ-শ্রেণি-জাতিগত ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা—কোথায় নেই রাজা রামমোহন রায়ের অবদান? তার মাধ্যমেই মধ্যযুগের ভারতে হলো বিপ্লব। অচলায়তন ভেঙে তিনি এনে দিলেন আলোর দুয়ার। সংস্কার, সামাজিক পুনর্গঠন ও আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা অনেক। তার এসব ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয় সবসময়ই। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র এবং সংবাদপত্রে তার পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি কেন যেন একটু আড়ালে পড়ে থাকে। অথচ সংবাদপত্রের মাধ্যমেই সমাজ পুনর্গঠন ও রেনেসাঁর ক্ষেত্রে অতুলনীয় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।

রামমোহন রায় সংবাদপত্রের মধ্য দিয়েই বিপ্লবের চেষ্টা করেছেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার  জন্য তিনি আজীবন ছিলেন সোচ্চার। সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে তিনি পৌঁছেছেন গণমানুষের মাঝে। সমাজ সংস্কারের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন সমাজের উচ্চতর স্তরেও। তুলে এনেছেন প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র। প্রশ্নের বানে বিদ্ধ করেছেন সমাজের সকল অনিয়ম, অনাচারকে।

রামমোহন রায়ের প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা ছিল ১৮০৩ সালে প্রকাশিত 'তাহাফত -উল-হুয়াহহিদ্দিন' বা 'একেশ্বরবাদীদের জন্য প্রদত্ত উপহার'। এই পত্রিকাটি  সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে খুবই সরব ছিল। ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত এই পত্রিকাতে উঠে আসত সমাজের প্রান্তিক মানুষের চিত্র। এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে এক ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন রামমোহন রায়।

সাপ্তাহিক 'সম্বাদ কৌমুদী' ছিল রামমোহন রায়ের দ্বিতীয় পত্রিকা। ১৮২১ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয় এ সাপ্তাহিক। প্রথমে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'সম্বাদ কৌমুদী'র সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেও, তার সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয় রামমোহন রায়ের। কারণটা অনুমেয়। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন গোঁড়া সমাজের প্রতিনিধি। বিরোধের জের ধরে ৩ মাস পরেই 'সম্বাদ কৌমুদী' ছেড়ে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়  কলকাতার কলুটোলায় নিজে প্রেস স্থাপন করে প্রকাশ করতে শুরু করলেন  'সমাচার চন্দ্রিকা', যা ছিলো  রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের মুখপত্র। ভবানীচরণের পর 'সম্বাদ কৌমুদীর'সম্পাদকের দায়িত্ব পান রাজা রামমোহন রায়ের ছেলে রাধা প্রসাদ রায়। সত্যিকার অর্থে, এই পত্রিকার মধ্য দিয়েই রাজা রামমোহন রায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ২ ভাবেই সংবাদপত্রের জগতে প্রবেশ করেন।  তখনকার হিন্দু সমাজের কুসংস্কারগুলো দূর করার জন্য সংস্কারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে 'সম্বাদ কৌমুদী' বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

কিন্তু ধর্মের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে লেখা প্রচারের জন্য, বিশেষ করে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে লেখার জন্য 'সম্বাদ কৌমুদী'র জনপ্রিয়তা কমে গেলে প্রচারসংখ্যাও নেমে যায়। ফলে পত্রিকটি ১৮৩৪ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

রামমোহন রায়ের তৃতীয় পত্রিকা ছিল  ১৮২২ সালে প্রকাশিত 'মিরাৎ উল্ আখবার' বা 'সময়ের দর্পণ'। শিক্ষিত সমাজ যেন দেশের মানুষের কথা অনুধাবন করে, দেশের মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসে— সে দিকে মনোযোগ ছিল এই পত্রিকার। একইসঙ্গে সাধারণ জনগণের প্রকৃত অবস্থাও তুলে ধরত পত্রিকাটি।  'মিরাৎ উল্ আখবার' ছিল প্রকৃত অর্থেই সমাজের দর্পণ। এটি প্রকাশিত হতো প্রতি শুক্রবার। 

রামমোহন রায়ের বাকি ২টি পত্রিকা ছিল 'জান-ই-জাহাপনামা ও 'বেঙ্গল হেরাল্ড'।  'জান-ই-জাহাপনামা' প্রকাশিত হতো উর্দু ও ফার্সি ভাষায়। আর  'বেঙ্গল হেরাল্ড'প্রকাশিত হতো ৪টি ভাষায়। টানা ১৩ বছর প্রকাশিত হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিফ আরোপ করলে  রামমোহন রায় এক পর্যায়ে পত্রিকা বন্ধ করে দেন।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আজীবন সোচ্চার ছিলেন রামমোহন রায়। তার নেতৃত্বেই ভারতীয় ও ইউরোপীয় সম্পাদকদের চাপে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক বিদ্যমান সংবাদপত্র আইন শিথিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন। গভর্নর জেনারেল জন অ্যাডাম ১৮২৩ সালে গৃহীত বেঙ্গল রেজুল্যুশন্স অনুসরণে সে বছর মুদ্রণের জন্য লাইসেন্স প্রথাও চালু করেছিলেন।

সংবাদপত্রের দিকদর্শনে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অসামান্য। কেবল একটি ভাষার মধ্যেই আবদ্ধ থাকেননি তিনি। সংস্কৃত থেকে শুরু ‍করে ইংরেজি, বাংলা, আরবি, উর্দু ফার্সি—সব ভাষাতেই সংবাদপত্রের মাধ্যমে বৈপ্লবিক ধারণা প্রচার করেছেন রামমোহন রায়।  ব্রাহ্মধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। তার ধ্যান-ধারণা, আত্মিক সংযোগ—সবটা জুড়েই ছিল মানুষ ও মানবিকতা। যে সত্য অনুসন্ধানে আজীবন অনুসন্ধিৎসু ছিলেন, তার প্রকাশমাধ্যম ছিল সংবাদপত্র। ধর্মীয় কুসংস্কার ও নানা প্রথার বিলুপ্তির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল এগুলো।   

আজ থেকে ঠিক ২৫০ বছর আগে হুগলীর রাধানগরের ব্রাহ্মণ পরিবারে রামমোহন রায়ের জন্ম। জন্মবার্ষিকীতে বাঙালির নবজাগরণের এই প্রবাদপুরুষের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র:

মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবন চরিত/ নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়

 রাজা রামমোহন রায়/ ড. শ্যামাপ্রসাদ বসু

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

20h ago