বাগদা ফার্মের সাঁওতালদের উচ্ছেদের চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন: ৪০ নাগরিকের বিবৃতি

বাগদা ফার্মের সাঁওতালদের উচ্ছেদের চেষ্টা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৪০ জন নাগরিক।
santal fire
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দিচ্ছে পুলিশ। ছবিটি ভিডিওচিত্র থেকে নেওয়া

বাগদা ফার্মের সাঁওতালদের উচ্ছেদের চেষ্টা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৪০ জন নাগরিক।

আজ সোমবার লিখিত বিবৃতিতে তারা বলেছেন, 'গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং অন্যান্য সূত্র থেকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আমরা জানতে পেরেছি, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ (বাগদা) ফার্মের জমিতে ইপিজেড স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত ১০ মে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান, স্থানীয় সংসদ সদস্য, গাইবান্ধার এসপি, গোবিন্দগঞ্জের মেয়রসহ বাগদা ফার্মের সাঁওতাল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটি সভায় মিলিত হয়েছিলেন।'

'অথচ সাঁওতাল নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদেরকে উক্ত সভায় তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর প্রতিবাদে স্থানীয় আদিবাসী সাঁওতালরা বিক্ষোভও করেছেন। তাদের দাবি, চিনিকলের জন্য আখ চাষ করা ছাড়া অন্য কিছু করা হবে না এই শর্তে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে এসব জমি রিকুইজিশন করেছিল। চিনিকলটি ২০০৪ সাল থেকে বন্ধ থাকায় সে শর্ত ভঙ্গ হয়েছে, তাই জমিগুলো তাদের কাছে ফেরত দিতে হবে, ইপিজেড নির্মাণের প্রশ্নই ওঠে না।'

'আমরা মনে করি তাদের এ দাবি যুক্তিসঙ্গত এবং কোনো অবস্থায়ই ৩ ফসলি জমিতে ইপিজেড স্থাপন করা কিংবা কোনো শিল্প কারখানা করা যাবে না মর্মে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও আছে।'

'স্থানীয় সাঁওতালদের দাবি, রিকুইজিশন করা ১ হাজার ৮৪২ একর জমির সঙ্গে তাদের আরও প্রায় ৬০০ একর জমি ফার্মের নামে অবৈধভাবে কুক্ষিগত করা হয়েছে। এক পর্যায়ে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের একাংশের যোগসাজসে এবং অসৎ সুগার মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর বাগদা ফার্ম এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় এবং উচ্ছেদের নামে তাদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।'

'এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে, ফলে ৩ জন আদিবাসী সাঁওতাল নিহত হন। কিছু পুলিশ সদস্য ও দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে সাঁওতালদের সহস্রাধিক বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত হয়। এ সংক্রান্ত হত্যা মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।'

'গভীর উদ্বেগ ও পরিতাপের বিষয়, ইপিজেড স্থাপনের উছিলায় আবার ক্ষতিগ্রস্ত ও অসহায় সাঁওতালদের ওই এলাকা থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদের নতুন কোনো পরিকল্পনার ছককাটা হচ্ছে বলে এই জনগোষ্ঠীর মানুষ আশংকা প্রকাশ করেছেন।'

'গত এক দশকে আমরা সবাই জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমপক্ষে ১০/১২ বার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, কোনো ২ বা ৩ ফসলি কৃষিজমি অকৃষিজ ব্যবহারের জন্য অধিগ্রহণ করা যাবে না। কিন্তু স্থানীয় এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী দুর্বৃত্ত চক্র এবং প্রশাসনের উচ্চাভিলাসী অসৎ কিছু কর্মকর্তা এই ঘটনার নেপথ্যে থেকে বিভিন্ন দুষ্কর্ম ও অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে এবং তাদেরই অতি উৎসাহী তৎপরতার কারণে সরকারি উদ্যোগ ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে।'

'ইপিজেড করতে হলে সেটির জন্য সরকারের জায়গার অভাব নেই। কারণ এর আগে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর সাকুয়া নামক স্থানে সরকারি খাসজমিতে ইপিজেড করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং সেই জায়গায় ইপিজেড না করে বাগদা ফার্মের ৩ ফসলি জমিতে ইপিজেড নির্মাণের চেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা লঙ্ঘন করার সামিল।'

'আমরা স্পষ্ট ভাষায় ইপিজেড কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে এ ধরণের জনবিরোধী, উস্কানিমূলক ও হঠকারী উচ্ছেদ পরিকল্পনা বা উদ্যোগ থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা মনে করি, কোনো চাপিয়ে দেওয়া অন্যায্য সিদ্ধান্তের ফল কখনও ভালো হয় না। একই সঙ্গে বিষয়টির প্রতি আমরা সরকারের, বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এবং তারই বহুল উচ্চারিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাগদা ফার্মের ৩ ফসলি কৃষিজমি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর পূর্বতন মালিকদের বংশধরদের অবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাই।'

বিবৃতিতে সই করেছেন, মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সামাজিক আন্দোলন নেতা পংকজ ভট্টাচার্য, মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নিজেরা করির সমন্বয়কারী ও এএলআরডি চেয়ারপার্সন খুশী কবির, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মোহম্মদ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য জেড আই খান পান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত, টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, নারীপক্ষ সদস্য শিরিন হক, বেলার প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রীরেব নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সহ-সভাপতি তবারক হোসেইন, আলোকচিত্রী ও সমাজকর্মী ড. শহিদুল আলম, কবি ও লেখক রাহনুমা আহমেদ, সেন্ট্রাল উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যন্সেলর ড. পারভীন হাসান, ব্রতির নির্বাহী পরিচালক শারমিন মোর্শেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন, অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, তাসনিম সিরাজ মাহবুব, সামিনা লুৎফা, ড. জোবায়দা নাসরিন, ড. মোহম্মদ তানজিব উদ্দিন খান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রেজাউর রহমান লেনিন, মানবাধিকার কর্মী হানা শামস আহমেদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, সাংস্কৃতিক কর্মী অনুপ রাহী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক নোভা আহমেদ, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা এবং এএলআরডি নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

10h ago