মহাকাশে মৃত্যু হলে মরদেহের কী হবে

অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে মানুষের মহাকাশ বিচরণ। এখন, বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণ কিংবা মঙ্গলে বসবাসের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী ধনীদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেফ বেজোস, ইলন মাস্ক, কিংবা রিচার্ড ব্রানসনের মতো বিত্তশালীদের চিত্তবিনোদনের জন্য ইতোমধ্যেই মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ করে দিতে শুরু করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। 
ছবি: সংগৃহীত

অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে মানুষের মহাকাশ বিচরণ। এখন, বাণিজ্যিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণ কিংবা মঙ্গলে বসবাসের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী ধনীদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেফ বেজোস, ইলন মাস্ক, কিংবা রিচার্ড ব্রানসনের মতো বিত্তশালীদের চিত্তবিনোদনের জন্য ইতোমধ্যেই মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ করে দিতে শুরু করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। 

মহাকাশভিত্তিক বাণিজ্যিক কোম্পানি ব্লু -অরিজিন তো তার গ্রাহকদের নিয়ে সাব-অরবিটাল ফ্লাইটে করে মহাকাশ ঘুরেও এসেছে। মঙ্গলে ঘাঁটি নির্মাণে স্পেস এক্সের প্রস্তুতিও চলছে জোরেসোরে, পিছিয়ে নেই ভার্জিন গ্যালান্টিকও। এসব উদ্যোগ বাণিজ্যিক মহাকাশ ভ্রমণের স্বপ্নকে যেমন বাস্তবায়িত করতে শুরু করেছে তেমনই রহস্যেঘেরা বিপজ্জনক মহাকাশে মানুষের মৃত্যু হলে কী হবে তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। 

এযাবৎকালে মহাকাশ ভ্রমণ ছিল কেবল কঠোর শারীরিক অনুশীলণ ও দক্ষ মানুষের কাজ। বাণিজ্যিক ভ্রমণকারীদের ক্ষেত্রে এই ধরনের মানদণ্ড আর থাকছে না। নিউ ইয়র্ক পোস্ট-এর তথ্যসূত্রে, গত অর্ধ-শতকে মহাকাশ অভিযানকালে দুর্ঘটনাসহ বেশ কিছু কারণে ৩০ জন নভোচারী প্রাণ হারিয়েছেন। মহাকাশকে বাণিজ্যিকীকরণের ফলে বেসামরকিদের প্রাণহানির সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যাবে।
 
কেউ বহনকারী জাহাজ থেকে ছিটকে মহাশূন্যে পড়লে মহাকাশের গভীর চাপে জ্ঞান হারাবে মাত্র ১৫ সেকেন্ডে, আর ৩০ সেকেন্ড থেকে এক মিনিটের মধ্যে হবে মৃত্যু। 

ছবি: সংগৃহীত

অক্সিজেনসহ খুব উন্নতমানের, ব্যয়বহুল ও শক্তিশালী একটা স্পেসস্যুট পরা থাকলে সময় পাবে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার মতো। এর মধ্যে উদ্ধার না হলে নিশ্চিত মৃত্যু। 

মহাকাশে মৃত্যু হলে মানবদেহের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে? কেউ কি এই নিষ্প্রাণ দেহগুলো পুনরুদ্ধার করতে যাবে? নাকি অনন্তকাল ধরে এগুলো মহাশূন্যে ভেসে বেড়াবে? আজ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে।

অভিযান কিংবা গবেষণার কাজে মহাকাশ ছিল কেবল নভোচারীদের দখলে। যারা দক্ষতা, কঠোর অনুশীলন ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনাচরণের পরেই মহাকাশের উদ্দেশে রওনা দেয়। এখানে প্রতিটা বিষয়, পদক্ষেপ অত্যন্ত হিসেব করে নেওয়া। তাই বিশেষজ্ঞ নভোচারীদের স্বাভাবিক মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব কম থাকে।

এরপরেও মানুষ মরণশীল, আর এমন অনিশ্চিতে যাত্রায় অদক্ষ পর্যটকদের মৃত্যু খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। এই ভ্রমণকাল খুবই সংক্ষিপ্ত, হয়তো কয়েক মিনিট বা সর্বোচ্চ কয়েক দিনের জন্যে হতে পারে। তারপরেও বাণিজ্যিক ভ্রমণে অনেক সম্ভাবনার সঙ্গে অনেক মৃত্যুরও সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।

১৯৮৬ সালে নাসার চ্যালেঞ্জার স্পেস শাটল বিস্ফোরণে প্রাণ হারানো নভোচারীরা। ছবি: নাসা

মহাকাশে মৃত্যু

পৃথিবীতে মৃত্যু হলে মানবদেহ বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে পচতে শুরু করে। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণের ফলে দেহ যেদিকে থাকবে রক্ত প্রবাহ কেবল সেদিকে প্রবাহিত হবে, অর্থাৎ একীভূত হবে। এই প্রক্রিয়া লিভর মর্টিস নামে পরিচিত। তারপর অ্যালগোর মর্টিসের কারণে মৃতদেহ ঠান্ডা হয় এবং পেশীর ফাইবারে ক্যালসিয়ামের অনিয়ন্ত্রিত গঠন তৈরি হয়, যাতে পেশী শক্ত হয়ে যায়। এটিকে বলে রিগর মর্টিস অবস্থা। 

এরপর এনজাইম, প্রোটিন যা রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো ত্বরান্বিত হয়, কোষগুলো ভেঙে তার উপাদানগুলো নির্গত হতে শুরু করে। এ সময়ে, আমাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কোমল টিস্যুগুলোকে গ্রাস করে, তাতে পচন ধরে এবং গ্যাসগুলো নির্গত হবার ফলে মৃতদেহ ফুলতে শুরু করে। 

এই পচন প্রক্রিয়াগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ। বাইরের কিছু কারণও এই পচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, যার মধ্যে তাপমাত্রা, পোকামাকড়ের কার্যকলাপ, দেহকে কবর দেওয়া বা মোড়ানো এবং আগুন-পানির উপস্থিতি অন্তর্ভুক্ত। এসব পৃথিবীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু, মহাকাশে বা অন্য কোনো গ্রহে মানবদেরহের লিভর মর্টিস পর্যায় প্রভাবিত হবে। মাধ্যাকর্ষণশক্তির অভাবে রক্তপ্রবাহ একীভূত হবে না। পৃথিবীর আবহাওয়া ও উপাদান মানুষের মৃতদেহকে নিঃশেষ হতে সাহায্য করে। মহাকাশে বাতাস, অক্সিজেন ও মাধ্যাকর্ষণের অভাবে ব্যাকটেরিয়া ঠিকভাবে কাজ করবে না। ফলে মরদেহ পচতে দীর্ঘকাল লেগে যেতে পারে। 

মাটি থেকে জীবাণুগুলো দেহকে পচতে সাহায্য করে। কিন্তু মহাশূন্যে এর অভাবে অতি শুষ্কতা নরম টিস্যু সংরক্ষণের সম্ভাবনা বাড়ায়। পৃথিবীর পরিবেশ থেকে ভিন্ন অবস্থার মধ্যে মরদেহ পচন কঙ্কালের মতো হতে পারে। মানুষের হাড় হাজার বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে। 

তবে, মহাকাশে বা অন্য কোনো গ্রহের গ্যাসীয় পদার্থের সংস্পর্শে উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারে। মঙ্গলগ্রহের শুষ্ক-মরুভূমির মতো অবস্থাতে কঙ্কালকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। আবার শীতল তাপমাত্রার গ্রহ, সূর্য থেকে যা বহুদূরে অবস্থিত সেখানে মরদেহ অনেকদিন টিকে থাকতে পারে। আবার বৃহস্পতি বা শনির মতো গ্যাসীয় গ্রহে মুহূর্তে গলেও যেতে পারে। 

মরদেহ থেকে সৃষ্ট জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া অন্য গ্রহের পরিবেশের জন্য হুমকি হতে পারে, তাই সেখানে কবর দেওয়া বা সৎকার করাতেও জটিলতা দেখা দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ সংস্থা

পৃথিবীর বাইরে মানুষের আবাসস্থল বলতে একমাত্র আন্তর্জাতিক মহাকাশ সংস্থা আছে। তবে, এই মহাকাঠামোতে সব মিলিয়ে ১১ জন জীবিত মানুষ বাস করতে পারে এবং সেখানে মর্গের কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রায় ৬ দশকে মাত্র ৩০ জন নভোচারীর মৃত্যু হওয়ায় এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে নাসার কোনো নীতিমালা করেনি। 

প্রাক্তন নভোচারী ক্রিস হ্যাডফিল্ড বলেছে, এমন পরিস্থিতি সামনে এলে কি করণীয় তা নির্ভর করে আইএসএস কমান্ডারের সিদ্ধান্তের ওপর। যদি আসলেই কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটে তাহলে সেটা খুবই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জীবিতদের স্বাস্থ্যের প্রতি অনেক যত্ন নেওয়ার দরকার পরে। তাছাড়া মরদেহ থেকে জীবাণু ছড়ানো স্বাভাবিক। এমন অবস্থায় মরদেহ কোনো বদ্ধ, চাপযুক্ত স্যুটে ভরে দূরবর্তী কোনো হিমায়িত স্থানে রাখতে হবে। 

ছবি: সংগৃহীত

২০০৫ সালের দিকে একটি সুইডিশ কোম্পানি মরদেহ হিমায়িত করে এবং সেগুলো হিমায়িত টিস্যুর ছোট ছোট টুকরো করে সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছিল। ফলে, এটা খুব অল্প স্থান নেবে, এবং জীবাণু-ব্যাকটেরিয়ার ঝুঁকিও কমাবে। এমনকি পৃথিবীতে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে আনাও যেতে পারে। হিমায়িত করতে দরকার তরল নাইট্রোজেন, তবে তা না থাকলে মহাকাশের শীতল তাপমাত্রায়ও কাজে লাগানো যেতে পারে।

মহাকাশে ভাসিয়ে দেওয়া

সিনেমা, উপন্যাস কিংবা বাস্তবের অনেক ঘটনা থেকে দেখা যায়, সমুদ্রে কেউ মারা গেলে নাবিকরা মরদেহ ভাসিয়ে দেয়। মহাকাশেও এমন উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। তবে, সেক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। সমুদ্রের চেয়ে মহাকাশের প্রক্রিয়া অনেক জটিল, সেখানে কোনো মাধ্যাকর্ষণ না থাকাতে যেখান থেকে ফেলা হবে সেখানেই ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে।

মরদেহগুলো মহাকাশের পরিবেশ দূষিত করতে পারে কিংবা মহাকাশে জঞ্জাল বাড়ার শঙ্কায় বিভিন্ন দেশ এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে পারে। তবে, কক্ষপথের কাছাকাছি কোনো দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে দেহাবশেষ উদ্ধার করা হতে পারে কিংবা পৃথিবিতেও ছিটকে পড়তে পারে। 

ঠিক যেমনটি ১৯৮৬ সালে নাসার চ্যালেঞ্জার স্পেস শাটল বিস্ফোরণে ঘটেছিল। ৪৬ হাজার ফুট উঁচুতে বিস্ফোরিত হয়ে মুহূর্তে ৭ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং আটলান্টিকে ছিটকে পড়ে। 

এ ছাড়া ২০০৩ সালে পৃথিবীতে ফেরার সময় নাসার কলাম্বিয়া শাটল ভেঙে গেলে ৭ নভোচারী প্রাণ হারান। তবে, দূরবর্তী কোনো অভিযানে কারও প্রাণহানি হলে মরদেহের  কী হয় তা জানা যায়নি। 

 

তথ্যসূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক পোস্ট, দ্য কনভার্সেশন, স্পেস ডট কম, হোয়াট ইফ

 

Comments

The Daily Star  | English

History of student protests in the USA

American campuses -- home to some of the best and most prestigious universities in the world where numerous world leaders in politics and academia have spent their early years -- have a potent history of student movements that lead to drastic change

4h ago