খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বীর উত্তম, বীর বিক্রম

আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের ৫৪তম পর্বে রইল আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বীর উত্তমের বীরত্বগাঁথা।)

মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী ছিলেন অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম পরিকল্পনাকারী এবং দলনেতা। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও নেতৃত্বের জন্য আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীকে বীর উত্তম, বীর বিক্রম দুই খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ৫৪ এবং বীর বিক্রম খেতাবে তার সনদ নম্বর ১৩৩।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। এসময় তার পদ ছিল সাব লেফটেন্যান্ট। পিএনএস ম্যাংরো ছিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর ফ্রান্সে তৈরি একটি সাবমেরিন। ১৯৭০ সালের ৫ আগস্ট পাকিস্তান নৌবাহিনীর এই সাবমেরিনটি কমিশন লাভের পর সে বছরের নভেম্বর মাসে  ৫৭ জন পাকিস্তানি সাবমেরিনারকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ৫৭ জন পাকিস্তানি সাবমেরিনারকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়। এর মধ্যে আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীসহ ১৩ জন ছিল বাঙালি সাবমেরিনার। মুক্তিযুদ্ধের মার্চ মাসে ফ্রান্সের তুলন বন্দরের কাছে পিএন এস ম্যাংরোতে প্রশিক্ষণে ছিলেন এই সাবমেরিনাররা। সেই সাবমেরিনে গোপন নথি ও জরুরী সংবাদ সিন্দুকের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিক গণহত্যার বিবরণ যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শুনলেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিসহ বাঙালি সাবমেরিনাররা পালাবেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। আর তাই ফ্রান্সের  তুলন বন্দরের সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে যখন তাদের সাবমেরিন ভিড়লো তখন ৪৫ জন ক্রুর পাসপোর্ট নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। তিনি চাইলে কেবল বাঙালিদের পাসপোর্টই সরাতে পারতেন কিন্তু তাতে সন্দেহের উদ্রেক হতো। এরপর আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীসহ বাঙালি সাবমেরিনাররা সিদ্ধান্ত নিলেন তারা পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিবেন। এদিকে তাদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় গোপনে আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীসহ বাকি ৭ বাঙালি সাবমেরিনার এক পাকিস্তানি গোয়েন্দাকে খুন করে পালান।

২৯ মার্চ এক আফ্রিকান বন্ধুর পরামর্শে তারা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারন ফ্রান্স থাকবে পাকিস্তানের পক্ষে যেহেতু ফ্রান্স থেকেই এই সাবমেরিন কেনা হয়েছে। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ড নিরপেক্ষ। এরপর একে একে নিজেদের পাসপোর্ট নিয়ে তারা তুলন ছেড়ে যান। কিন্তু ফ্রান্সের সীমান্তে গিয়ে জানতে পারলেন সুইজারল্যান্ডে যেতে হলে ভিসা লাগবে। এসময় কাস্টমসে দায়িত্বপ্রাপ্ত নারীকে উপস্থিত বুদ্ধিতে তারা বলেছিলেন, তারা প্যারিস থেকেই সুইজারল্যান্ডের ভিসা সংগ্রহ করবেন। এরপর প্যারিসগামী ট্রেনে উঠে স্পেনের লিওনে নেমে যান আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীরা। লিওন থেকে বার্সেলোনার ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করলে তাদের পাঠানো হয় রাজধানী মাদ্রিদে। ভারতে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের কাগজপত্রের ব্যবস্থা হয়ে যায় এদিকে তাদের রোম পৌঁছানোর খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল পাকিস্তানি দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং প্রবাসী পাকিস্তানিরা। এসময়  তারা সাংবাদিকদের বলেন, 'আমাদের দেশ এখন স্বাধীন। আমরা আমাদের দেশের জন্য লড়াই করতেই দেশে ফিরে যাচ্ছি।'

নিউইয়র্ক থেকে ছেড়ে আসা  তাঁদের বিমান ছিলো প্রায় ১০ ঘণ্টা পরে। কিন্তু ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি ভারতীয় দূতাবাস। কারণ ইতালির সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো বলে ইতালি তাদের গ্রেফতার ও করতে পারে। তাই তাদের পাঠানো হয় সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। সেখান থেকে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই বোম্বের বিমানে উঠে যান। ৯ এপ্রিল দিল্লিতে এসে পৌঁছান আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীসহ বাঙালি সাবমেরিনাররা।

দিল্লিতে আসার পর সিদ্ধান্ত হয় এই সাবমেরিনাররা নৌ অপারেশনে যুক্ত হবেন।  এরপর আটজনের সঙ্গে আরও ১২ জনকে মিলিয়ে মোট ২০ জনের একটি গেরিলা দল গঠন করা হয়েছিলো।  ২৩ মে নৌ কমান্ডো সেক্টর গঠনের পর বিভিন্ন সেক্টর থেকে বাছাইকৃত ৩০০ প্রশিক্ষণার্থীকে টানা আড়াই মাস পলাশীর ভাগীরথী নদীর তীরে  প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এই নৌ কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ভারতীয় ২০ প্রশিক্ষক এবং আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীসহ ৮ বাঙালি সাবমেরিনার।  এরই মধ্যে  অপারেশন জ্যাকপটের অভিযান পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে যায়।

১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর অপারেশনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। এই অপারেশন অংশ নিয়েছিল ৬০ জন নৌ কমান্ডো।

২ আগস্ট দুপুর  ২টায় আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দলটি পলাশী ঘাঁটি ত্যাগ করে সামরিক ট্রাকে রওয়ানা দিয়ে রাতে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে পরদিন সকালে দমদম বিমানঘাঁটি থেকে ড্যাকোটা বিমানে চেপে ৪ আগস্ট ভোরে আগরতলায় এসে নিউক্যাম্পে উঠেন। এরপর  ৬-৮ আগস্ট অপারেশনের নানা পরিকল্পনা ও আবহাওয়া বার্তা জানানো হয় কমান্ডোদের।

৮ আগস্ট হরিণায় আসার পরে দলটিকে তিন ভাগ করে প্রতিটি দলে একজন করে কমান্ডার করা হয়। তারপর সাব্রুম সীমান্ত দিয়ে  লিমপেট মাইন, ফিনস, গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ, শুকনো খাবার,  কাপড়চোপড় এবং ২০ কেজি ওজনের বোঝা নিয়ে সারারাত দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ পথ হেঁটে শ্রীনগর ক্যাম্প হয়ে প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন কমান্ডোরা। এরপর জিনারহাট, রানাঘাট, ফাজিলপুর হয়ে কেএমহাট বাজারে এসে পৌঁছান। গাইড পরিবর্তনের পর বৃষ্টিভেজা রাতে তিনটি বড় নৌকায় মুহুরি ও ফেনী নদী দিয়ে ৯ আগস্ট দুপুরে মীরসরাইয়ের ইছাখালী গ্রামে এসে পৌঁছান কমান্ডোরা। ১০ আগস্ট রাতে কমান্ডোরা সেখান থেকে রওয়ানা দিয়ে ১২ আগস্ট মধ্যরাতে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী সমিতির  হাটে এসে তরকারি বিক্রেতার ছদ্মবেশে তরকারির ঝুড়ির নিচে মাইন ও বিস্ফোরক রেখে উপরে সবজি সাজিয়ে দরগার হাট থেকে বাসের ছাদে চেপে চট্টগ্রামে যান।

১৩ আগস্ট দুপুরে অপারেশনে অংশ নেয়া দুটি দলই চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের মমতাজ মহলে পৌঁছান। ১৩ আগস্ট রাতেই রেডিওতে বেজে উঠে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে —'আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান'। এই গান শোনার পর দলনেতা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, ১৪ আগস্টের মধ্যেই শহর অতিক্রম করে কর্ণফুলী পাড়ি দিয়ে  আনোয়ারার  লক্ষ্যার চরে অস্ত্র পৌঁছানো হয়। এদিকে ৪০ জন কমান্ডো আসতে পারলেও ২০ জন কমান্ডোর একটি দল পাকিস্তানীদের প্রতিরোধে আটকা পড়ে অপারেশনে অংশ নিতে পারেনি।

১৫ আগস্ট সকালে বেজে ওঠে দ্বিতীয় গান 'আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি।' এদিকে শেষ মুহূর্তে ৩ জন কমান্ডো অপারেশনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় কমান্ডোর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৭ জনে।

প্রতি গ্রুপে ৩জন করে মোট ১২টি গ্রুপ করে কমান্ডোরা ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই এসে পৌঁছান কর্ণফুলী নদীর তীরে।  নির্দিষ্ট ৩জনের গ্রুপ পায়ে ফিনস ও গামছা দিয়ে বুকে মাইন বেঁধে কোমরে ড্যাগার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন কর্ণফুলী নদীর জলে। এসময়ে পাহারায় থাকা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, মোজাহার উল্লাহ এবং ডা. শাহ আলম ও খোরশেদসহ বাকি ৩ কমান্ডো কমান্ডোদের বিদায় জানান।

রাত ১টার দিকে কর্ণফুলীর জলে ডুবে ৩ জনের একেকটি দল হাতে হাত রেখে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিঃশব্দে সাঁতার কেটে এগিয়ে যায়। ৩ জনের একটি গ্রুপ একটি টার্গেটের তিনটি স্থানে মাইন লাগিয়ে রাবার ক্যাপ খুলে সেফটি পিন নিয়ে পুনরায় সাঁতরিয়ে নির্দিষ্ট আশ্রয়ে ফিরতে থাকেন। কমান্ডোরা নদীতে থাকা অবস্থাতেই ফাটতে শুরু করে মাইনগুলো। পাকিস্তানি বাহিনীর জাহাজ ও বাণিজ্যিক জাহাজগুলো  আক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পেরেই প্রচণ্ড শব্দে সাইরেন বাজায়। এসময়েই পাকিস্তানিরা নদীর দুইপাশে গানবোট থেকেই শুরু করে গুলিবর্ষণ। বাণিজ্যিক জাহাজ থেকেও এসময় এসওএস বার্তা পাঠাতে শুরু করে। রাত দেড়টা দিকে দুটোর মধ্যে মাইনগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে। সেদিন তাদের অপারেশনে প্রায় ১০টি টার্গেট এমভি আল আব্বাস, এমভি হরমুজ, মৎস বন্দরে নোঙ্গরকৃত বার্জ ওরিয়েন্ট, নৌ বাহিনীর ২টি গানবোট। এছাড়া ছোট কয়েকটি বার্জ সম্পূর্ণ ডুবে যায়।

অপারেশন জ্যাকপট মুক্তিবাহিনীর জন্য সাফল্যের ছিল যে এরপর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘের কাছে জাহাজ ডোবানো বন্ধের জন্য হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অন্যান্য দেশের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'কোন দেশ যেন বাংলাদেশের জলসীমায় তাদের জাহাজ না পাঠায়। নয়তো আমাদের সেনারা তা ধ্বংস করবে।' এরপরে বিদেশি কোন পণ্যবাহী জাহাজ সেপ্টেম্বর থেকে বন্দরে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার উত্তর শ্রীপুর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে কমোডর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বীর উত্তম।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ১০ম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস ১০ম খণ্ড

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Can't afford another lost decade for education

Whenever the issue of education surfaces in Bangladesh, policymakers across the political spectrum tend to strike a familiar chord. "Education is our top priority," they harp

2h ago