সেই ঈদগুলোতে আনন্দ ছিল, চাকচিক্য ছিল না

আমরা যখন স্কুলে পড়ি, সেই ৭০/৮০ দশকে, তখন ঠিক ঈদের আগের রাতে কলোনির শিশু-কিশোররা একটা মিছিল বের করতাম, আর বাঁশি বাজাতে বাজাতে কলোনি প্রদক্ষিণ করতাম। শ্লোগান দিতাম, 'কাল ঈদ, কাল ঈদ'।

বেশ বড় হওয়া পর্যন্ত কলোনির ছেলে-মেয়েরা এই মিছিল বের করেছি। রোজার ঈদেও, কোরবানির ঈদেও। এই মিছিল দিয়েই শুরু হতো আমাদের ঈদ আনন্দ।

কোরবানির ঈদের আগে যখন হাট থেকে গরু-ছাগল কিনে আনা হতো, তখন কলোনিতে একটা হইচই পড়ে যেতো দাম জানার জন্য। কেন সবাইকে ওই গরু বা ছাগলের দাম জানতে হবে সেটা বুঝতাম না। তবে ব্যাপক আনন্দ ছিল 'ভাই কত হইলো?' জিজ্ঞাসা করার মধ্যে। ভাইরাও একটুও বিরক্ত না হয়ে হাসি মুখে উত্তর দিতেন, ১০ হাজার, ১৫ হাজার বা ২০ হাজার টাকা। এটা ছিল গরুর দাম। আর খাসির দাম ছিল ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা।

অনেকেই এই দাম জিজ্ঞাসার ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য গলায় দামটা ঝুলিয়ে দিতেন বড় করে। তখনতো এত মিডিয়া, বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়া ছিল না। তাই হাটে গরুর দাম-দর বোঝার জন্য বা জানার জন্য এটি একটি পদ্ধতি হতে পারে।

কোরবানির ঈদের বিশেষ মরতবা ছিল কোরবানি দেওয়ার জন্য আনা খাসী বা গরুটি এবং সেটাকে নিয়ে শিশু-কিশোরদের আনন্দ। অনেকে বুঝতেই পারতেন না যে এই বন্ধুটি ২ দিনের অতিথি। অনেক শিশুর এই গরু-ছাগলকে পাতা খাওয়াতে খাওয়াতে এবং আদর করতে করতে হৃদ্যতা গড়ে উঠতো।

আর তাই প্রায় প্রতি ঈদেই কোরবানি দেওয়ার সময় একটা কান্নাকাটির পরিবেশ তৈরি হতো। কিছুতেই শিশুরা এটা মেনে নিতে পারতো না। এরকম একটি ঘটনায় আমাদের এক বন্ধু এতই ভেঙে পড়েছিল যে ও কোরবানির গোশত খায়ইনি, বরং কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সেবার থেকে তার বাবা কোরবানি ঈদের ঠিক আগের রাতে কোরবানির পশু কিনে আনতেন, আদনানকে না জানিয়ে।

সেইসময় প্রায় প্রতিটি পরিবারে সাধারণত একটি করে খাসি বা গরুর এক ভাগ কোরবানি দেওয়া হতো। অনেক ধনীরা একের অধিক বা একটি গরু কোরবানি দিতেন। তবে সেই সংখ্যা ছিল খুব কম। তখন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যেমন কম ছিল, জৌলুস দেখানোর প্রবণতাও কম ছিল। কোরবানি দেওয়াটা ফরজ বলে যে যার সাধ্য সেটি পালন করতো। কোরবানি দেওয়া হতো বলে সেই ঈদে তেমন কোনো কেনাকাটাও হতো না আমাদের জন্য। পুরনো কোনো জামা জমিয়ে রাখতাম কোরবানির ঈদে পরবো বলে। সেইসময়ে আমরা যারা বড় হয়েছি, এইভাবেই ঈদকে দেখেছি, আনন্দ করেছি, প্রাণ দিয়ে উপভোগ করেছি।

সেই গরুর ভাগ দাঁড়িপাল্লা দিয়ে সমান ৩ ভাগ করা হতো। এরপর পেপার দিয়ে মুড়িয়ে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাসায় পৌঁছে দেওয়া হতো। কাদের বাসায় গোশত যাবে এর একটা তালিকা করা হতো। তখন অধিকাংশ বাসায় ফ্রিজ ছিল না বলে প্রায় পুরোটা গোশত একবারেই হাড়িতে চড়িয়ে দেওয়া হতো। এরপর টানা ৬ থেকে ৭ দিন ধরে চলতো ঝুরা মাংস খাওয়া।

ফ্রিজ আসার পর কিছু মাংস রেখে দেওয়া হতো কাবাব জাতীয় কিছু বানানোর জন্য। আম্মাকে দেখতাম কিছু মাংস দড়িতে ঝুলিয়ে শুটকি বানাতে দিতেন, মহরমের দিন খাবেন বলে।

এখন অবশ্য কোরবানি দেওয়া ও কেনাকাটার চেহারা একেবারে পাল্টে গেছে। বাজারে গরুর সাইজ ও দাম নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ৩০ থেকে ৪০ মণ ওজনের গরু বানানো হচ্ছে। দাম ধরা হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। এখানেই শেষ নয়, যেকোনো একজন তারকার নাম বেছে নিয়ে গরুর নাম রাখা হচ্ছে।

প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কতটা অসভ্য হয়েছি আমরা। একবারও কি ভেবেছি যে গরুগুলোকে কতটা অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে এই ওজন বাড়াতে গিয়ে। তার মাংস কতটা স্বাস্থ্যকর হবে? গরুটিকে কোনো ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে কিনা?

বরং ইদানিং লক্ষ্য করছি মানুষের হাতে অনেক সাদা-কালো টাকা এসেছে, সেই টাকা দেখানোর একটা ভালো জায়গা হচ্ছে এই কোরবানির হাট। সমকালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি আসাদ চৌধুরী বলেছেন, 'কোরবানির হাট টাকার গরম দেখানের জায়গা নয়।' অথচ আমরা দেখছি ব্যাপারটা অনেকটা তাই ঘটছে, মানে টাকার গরম দেখানো হচ্ছে। কে, কত টাকায় কোরবানির জন্য পশু কিনছেন সেটা অনেকের ক্ষেত্রেই বড় ব্যাপার। বাজারে আসা বিরাট আকারের গরুগুলো সেইজন্যই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসছে, খবর হচ্ছে, ক্রেতার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হচ্ছে।

অথচ একটা সময় ছিল যখন একটা ভাগ কোরবানির টাকা যোগাতে মধ্যবিত্তকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হতো। ঈদে বোনাস পাওয়ার ব্যাপারটাও খুব একটা নিয়মিত কিছু ছিল না। তাই কোরবানি দেওয়াটা খুব মূল্যবান কিছু ছিল। আব্বা একবার একটা খাসি কিনে আনলেন কোরবানি দেবেন বলে। একদিন পরে ঈদের সকালে উঠে দেখলাম খাসিটা কে বা কারা সিঁড়ি ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। সবার খুব মন খারাপ হলো।

তবে তখন কিন্তু আমরা পাকিস্তানি ক্রিকেটার কামরান আকমলের পরিবারের মতো হারিয়ে যাওয়া ছাগল খুঁজতে বের হইনি। এ বছর তাদেরও চুরি হয়ে গেছে কোরবানির ছাগল। তারা পরিবার শুদ্ধ সেই ছাগলগুলো খুঁজে বেড়িয়েছেন। আমাদের ছাগলটি হারিয়ে যাওয়ার পর আব্বা বললেন, 'নিয়তে বরকত। আমার পক্ষেতো আরেকটা খাসি কেনা সম্ভব নয়, কাজেই এটাই কোরবানি ধরে নিতে হবে। যাই ২ কেজি গোশত কিনে আনি।' পরে অবশ্য বিভিন্ন বাসা থেকে কোরবানির মাংস এসেছিল।

কোরবানি দেওয়াটা এখন যতোটা ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, ঠিক ততোটাই লোক দেখানোর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর তাইতো সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হচ্ছে কোরবানির গরু বা খাসির দাম বলে বেড়াবেন না, বাড়তি মাংস সংরক্ষণ করবেন বলে বড় সাইজের ফ্রিজ কিনবেন না, ওজনে এদিক-ওদিক করবেন না। তবে আর যাই করুন, এমনভাবে কোরবানির মাংস বিলি করবেন না যাতে পদদলিত হয়ে মানুষ মারা যেতে পারে।

কোরবানির হাটের একটি সত্যি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। আমার এক ভাই এবং তার কয়েক বন্ধু মিলে চাকরির পাশাপাশি শুরু করছিলেন গরুর ব্যবসা। মানিকগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে গরুর বড়সড় একটি খামার। ঢাকা থেকেই তারা এই ব্যবসা পরিচালনা করতেন। করোনা মহামারির আগের বছর ঈদে তারা কমলাপুর গরুর হাটের ভিআইপি গ্যালারিতে, মানে ছাউনির নীচে স্টল পেয়েছিলেন। সেখানে বসার জন্য ৫টি চেয়ারও ছিল।

সেই ঈদের আগের দিন, মানে শুক্রবার বিকেল নাগাদ বিক্রির জন্য আর একটিমাত্র গরু বাকি ছিল। তাদের সাপোর্ট স্টাফরাও বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তারা খেয়াল করলেন, দুপুর থেকেই একজন বয়স্ক মানুষ ২/৩ বার ঘুরে ঘুরে এসে তাদের গরুটি কেনার জন্য দরদাম করেছেন। প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ বছরের ওই বৃদ্ধের পরনে সাদা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবী, ধবধবে সাদা চুল-দাঁড়ি, বেশ নূরানি চেহারা। দামে বনিবনা হচ্ছিল না বলে ভদ্রলোক বারবার আসা-যাওয়া করছিলেন।

বিকেলে তিনি আবার এলেন। শেষ পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা যে গরুর দাম চাওয়া হচ্ছিল সেটা এক লাখে বিক্রি করতে রাজি হলো। কারণ প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, তারাও আর বসে থাকতে চাইছিলেন না। চাচা শেষ পর্যন্ত ৯৫ হাজার টাকা দিলেন। কিছুতেই তার পকেট থেকে পুরো এক লাখ টাকা বের করা গেল না।

গরুটি কেনার পর চাচা সেখানেই একটি চেয়ারে বসলেন এবং গরুটিকে সেখানেই বেঁধে রাখলেন। তারা দেখলো চাচা কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন। ১০ মিনিটের মধ্যে ২ জন এসে চাচার কাছ থেকে গরুটি নিয়ে যায়, আর চাচাকে ১ লাখ ২৫ দেয়। চাচা ওখানে বসেই ওই গরুটা এই দামে বিক্রি করে দিলেন।

এই ঘটনা দেখে ওদেরতো ভিরমি খাওয়ার দশা। একি! চাচা ওদের থেকে গরুটি ৯৫ হাজারে কিনে, ওদেরই পাশে বসে সেটা ৩০ হাজার টাকা লাভে বিক্রি করে দিলেন! কী কেরামতি। ওরা প্রায় হতভম্ব অবস্থায় চাচা মিয়াকে সালাম করতে চাইলে, চাচা বলে উঠলেন, 'বাবারা সালাম করন লাগবো না। আমি তোমাদের বুদ্ধির বই পড়তে দিমু।' এ কথা বলে হাসতে হাসতে 'ঈদ মোবারক' বলে চলে গেলেন।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

7h ago