বর্ষাকালে সাপের উপদ্রব, জনমনে আতঙ্ক ও আমাদের করণীয়

সাপের কথা শুনলেই অজানা আতঙ্কে মানুষের গা শিউরে উঠে। আবার অনেকে সাপ দেখামাত্র মেরে ফেলতে উদ্যত হন। সাপ মেরে নিজের ক্ষমতা আর শক্তিমত্তা জাহির করতে চান। সাপ নিয়ে অজ্ঞতা, সঠিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব ও কুসংস্কারে বিশ্বাস এর মূল কারণ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে অ্যান্টিভেনম তৈরিতে সাপ নিয়ে গবেষণা চলছে। ছবি: রাজীব রায়হান

সাপের কথা শুনলেই অজানা আতঙ্কে মানুষের গা শিউরে উঠে। আবার অনেকে সাপ দেখামাত্র মেরে ফেলতে উদ্যত হন। সাপ মেরে নিজের ক্ষমতা আর শক্তিমত্তা জাহির করতে চান। সাপ নিয়ে অজ্ঞতা, সঠিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব ও কুসংস্কারে বিশ্বাস এর মূল কারণ।

সর্পবিদ ও গবেষকদের মতে, সাপ খুব ভীতু প্রকৃতির সরীসৃপ। বর্ষাকালে সাপের উপদ্রব বাড়ে। বাংলাদেশে প্রায় ১০৩ প্রজাতির সাপের দেখা মেলে, তার মধ্যে ২৮ প্রজাতি বিষধর। অন্য প্রজাতিগুলো নির্বিষ। বিষধর ২৮ প্রজাতির সাপের মধ্যে ১৩ প্রজাতি সামুদ্রিক, বাকি ১৫ প্রজাতির সবগুলোর সবগুলোর দেখা মেলে না। আমাদের দেশে বিষধর সাপের মধ্যে চন্দ্রবোড়া, পদ্ম গোখরা, গোখরা, কালাচ, সিন্ধুকালাচ, কালকেউটে, লালগলা ঢোড়াসাপ, সবুজ বোড়া, শঙ্খচূড়, শঙ্খিনী প্রজাতির দেখা মেলে।

কামড়ানোর প্রবণতা: অধিকাংশ সাপই নিরীহ শান্ত-স্বভাবের। সহজে কাউকে কামড়ায় না। সাপ মানুষের পায়ের নীচে চাপা পড়লে, বিপদের আভাস পেলে বা কেউ বিরক্ত করলে, ভয় পেলে, অথবা কারও শরীরের সংস্পর্শে এলে আত্মরক্ষার্থে কামড়াতে পারে। সেক্ষেত্রেও বিষহীন কামড়ের সংখ্যাই বেশি। কারণ বিষ সাপের কাছে মূল্যবান অস্ত্র।

কামড়ের ধরন: বিষধর সাপ যেখানে কামড় দেবে, সেখানে একাধিক বা একটি দাঁতের ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট দেখা যাবে। আর যদি অনেকগুলো সারিবদ্ধ দাঁতের ক্ষত দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে সেটা নির্বিষ সাপের কামড়।

বিষধর সাপের কামড়ে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে: চোখ বুজে আসবে, ঘুম ঘুম লাগবে বা চোখ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ঘাড় একদিকে হেলে পড়বে, ঘাড় ভেঙে বাঁকা হয়ে যাবে, জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে যাবে, অস্পষ্টভাবে কথা বলবে। এ ধরনের ব্যক্তি সোজা হয়ে বসতে বা মানুষকে চিনতে পারবে না, শুয়ে পড়তে চাইবে। দংশনের জায়গা ফুলে উঠতে পারে, ফোস্কা পড়তে পারে বা ঘা হতে পারে। রক্তের কণিকা ভেঙে যাওয়ায় রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না। রক্ত নালী ছিঁড়ে যেতে পারে, টিস্যু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফোস্কা ফেটে গিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে। পেটে তীব্র ব্যথা, কিডনি আক্রান্ত হতে পারে। শরীরের ভেতরের অঙ্গ আক্রান্ত হয়ে রক্ত বমি, রক্ত পায়খানা হতে পারে, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হতে পারে। প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

চিকিৎসা সম্পর্কিত সাধারণ ভুল: সাপ দংশনের সঙ্গে সঙ্গে ওঝা বা কবিরাজের কাছে যাওয়া। দংশনের জায়গা ব্লেড দিয়ে কেটে দেওয়া। মুখ দিয়ে চুষে রক্ত বের করে দেওয়া ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রকার বাদ্য বাজনা বাজানো, দলবদ্ধভাবে গান গাওয়া, ধুমপান করা ও দংশিত ব্যক্তিকে কাত-চিত করা।

চিকিৎসা: রোগীকে মানসিক সাহস দেওয়া, বিষধর সাপ দংশন করেছে নিশ্চিত হওয়া মাত্রই সময় নষ্ট না করে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেনারেল হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল যেখানে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যাবে, সেখানেই নিয়ে যাওয়া। দংশনের জায়গায় কোনো ধরনের এসিড বা মরিচের গুড়ো দেওয়া যাবে না। কোনো প্রকার তাবিজ, তেল, বড়ি জাতীয় কিছু লাগাবেন না। যানবাহনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মোটর সাইকেল ব্যবহার করা যাতে সময়ক্ষেপণ না হয়। হাত-পা ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রতঙ্গ নড়াচড়া না করা, দংশিত ব্যক্তিকে স্থির রাখার ব্যবস্থা করা। বিষাক্ত সাপে ছোবল মারার দুই ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি। সাপে কাটলে তাৎক্ষণিকভাবে আংটি, চুরি, ব্রেসলেট, ঘড়ি খুলে ফেলুন। ঘাবড়াবেন না, বেশি ঘাবড়ালে মনোবল ভেঙে যাবে। সর্বোপরি মহান আল্লাহ তায়ালার সহায়তা কামনা করুন, যিনি আপনাকে মুহূর্তের মধ্যেই পরিত্রাণ দিতে পারেন।

সাপের দংশন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় এবং সর্তকতা: বাড়ির চারপাশে ঝোপ-জঙ্গল, আর্বজনা থাকলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। ইঁদুরের গর্ত থাকলে সেগুলো ভরাট করে দেওয়া। রাতে বাইরে বের হলে টর্চ লাইট ব্যবহার করা। বিস্তীর্ণ মাঠে কৃষি ফসল উৎপাদন বা গৃহপালিত পশু চরানোর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের গামবুট বা প্রয়োজনবোধে হ্যান্ড গ্ল্যাভস ব্যবহার করা। বাড়ির আঙিনায় গর্ত, ইটের স্তূপ, কাঠের স্তূপ, খড়ের পালা, আর্বজনার স্তূপ, পাথরের ফাঁক, বুট বা জুতায় হাত দেওয়া বা পায়ে পরার আগে ভালো করে দেখে নেওয়া। অন্ধকারে পথ চলার সময় লাঠি দিয়ে ঠুকঠুক শব্দ করে পথ চলা। কখনো সাপ সামনে পড়ে গেলে, ভয় না পেয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া বা নীরবে সর্তকতার সঙ্গে বিকল্প পথ ব্যবহার করা। মৃত বা জীবিত, বিষাক্ত বা নির্বিষ যে সাপই হোক না কেন নিজেকে জাহির করা বা বীরত্ব প্রকাশের জন্য ধরার চেষ্টা না করা। কারণ জীবিত সাপ মরার ভান করে শুয়ে থাকতে পারে। রাতে ঘুমানোর আগে বিছানার আশপাশে ভালো করে দেখে নেওয়া বা চাদর, বালিশ, লেপ, কাঁথা ভালো করে ঝেড়ে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে যাওয়া। রাতের বেলা বিছানা থেকে নামার আগে আলো জ্বালিয়ে ভালোভাবে দেখে নেওয়া। বাড়ির আঙিনায় সাপের উপদ্রব দেখা দিলে চারপাশ পরিষ্কার করে সপ্তাহে ১ (এক) বার পরিমিত আকারে ব্লিচিং পাউডার ছিটানোর ব্যবস্থা করা। বাড়িতে খড়ের গাদা, লাকড়ির স্তূপ থেকে খড় বা লাকড়ি সংগ্রহের আগে লাঠি দিয়ে শব্দ করুন।

একমাত্র সতর্কভাবে চলাফেরাই মানুষকে সাপের দংশন থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। আমাদের দায়িত্বশীল আচরণে প্রকৃতিতে মুক্তভাবে বাঁচবে সাপ।

 

মো. জাহাঙ্গীর কবির: বন্যপ্রাণী পরিদর্শক, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, রাজশাহী

Comments

The Daily Star  | English
Effects of global warming on Dhaka's temperature rise

Dhaka getting hotter

Dhaka is now one of the fastest-warming cities in the world, as it has seen a staggering 97 percent rise in the number of days with temperature above 35 degrees Celsius over the last three decades.

10h ago