হাতির ৫ পা দেখা শুরু ১২ নম্বর গভর্নরের

ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট অর্থখাতের প্রভাবশালীদের হিম্মত দেখতে শুরু করেছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। যদিও তা না দেখা বা না জানার ব্যক্তি নন তিনি। অর্থসচিব থাকাকালে কম-বেশি অবশ্যই দেখেছেন।

অর্থ খাতের সাচিবিক দায়িত্ব পালনের সময় এর ভেতর-বাইরের অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা এই গভর্নরের সামনে চ্যালেঞ্জের পাঠ ছিল ৩টি। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে বাড়ানো। কিন্তু এ ৩ এর বাইরে তিনি দেখা শুরু করেছেন হাতির ৫ পা। যোগদানের ২১ দিনের মাথায় তাকে নিতে হয় চরম পাঠ।

দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে জনতা ব্যাংকের প্রধান ৩ শাখার বৈদেশিক ঋণ কার্যক্রম মঙ্গলবার বন্ধ করে বুধবার সন্ধ্যায় তা খুলে দিতে বাধ্য হন তিনি। হাকিমের হুকুম বদলাতে হয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। হুকুম বদলের এ ক্ষমতাধরদের থামানোর উপায় নেই—১২ নম্বর গভর্নরের তা অজানা ছিল? মতিঝিল ব্যাংকপাড়া সম্পর্কে মোটামুটি খোঁজ রাখা ব্যক্তিরা কিন্তু জানেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে আরও আগেই।

এতে অবাক হওয়া ব্যক্তিরা কি জানেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছিল মূল্যস্ফীতির নিচে কোনো ব্যাংক আমানতের সুদের হার নির্ধারণ করতে পারবে না। এখন সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তাহলে যেসব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? বা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব? জনতা ব্যাংকের ঘটনা তো উদাহরণ মাত্র। জনতা ব্যাংকের শাখা ৩টি হলো—ঢাকার জনতা ভবন করপোরেট, লোকাল অফিস ও চট্টগ্রামের সাধারণ বীমা ভবন করপোরেট শাখা।

একাধিক সূত্রের হিসাব হচ্ছে, জনতা ব্যাংকের ৭৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের অর্ধেকই এই ৩ শাখায়। আর প্রভাবশালীরা এই ৩ শাখারই গ্রাহক। তাদের কাছে হারতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বিরতি দিয়ে কিছু ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে দেশের শীর্ষ খেলাপি ও প্রভাবশালীরা ব্যাংকটির বড় গ্রাহক।

পরিকল্পিতভাবে গত ৫-৬ বছরে রাষ্ট্রীয় এই ব্যাংকটিকে কব্জা করে নিয়েছেন তারা। বর্তমান গভর্নর সদ্য সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের তা জানার বাইরে নয়। এর আগে শেষ কর্মদিবসে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গভর্নর ফজলে কবির বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আর ডলারের রেট ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ রেখে যাচ্ছি।

এই চ্যালেঞ্জের কী দশা যাচ্ছে, তা অর্থনীতি না জানা-না বোঝা মানুষের কাছেও আয়নার মতো ঝকঝকে-তকতকে। চ্যালেঞ্জের সংখ্যা ৩ বলা হলেও ডানে-বামে, আগে-পিছে খুচরা কতো চক্করের মাত্র একটিতে পড়েছেন নয়া গভর্নর। কোনো বুঝ-জ্ঞান বা হিসাব-নিকাশ ছাড়া তিনি চেয়ারে বসেছেন বিষয়টি মোটেই এমন নয়। যোগদানের ক্ষেত্রে তার ধীর কদমের ঘটনায়ও ছিল সেই বুঝ-জ্ঞান ও সাবধানতার ছাপ।

তার আগের গভর্নর ফজলে কবিরের মেয়াদ ৩ জুলাই শেষ হওয়ার পর ৪ জুলাই দায়িত্ব নিতে পারতেন তিনি। কিন্তু নেননি। ঝুট-ঝামেলা এড়ানোর হোমওয়ার্কের অংশ হিসেবে তার এই সতর্কতা। রউফ তালুকদারের চাকরি আছে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত। গভর্নর হতে তাকে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিতে হয়। ১১ জুলাই থেকে তার স্বেচ্ছা অবসর আবেদন রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে অনুমোদন করিয়ে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর দ্বাদশ অধ্যায়ে অবসর, ইস্তফা ইত্যাদি মিটমাট করেছেন।

চাকরির বিধানে উল্লেখ আছে, সরকারি চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় একজন সরকারি কর্মচারী অবসর নিতে পারেন। অবসর গ্রহণের ৩০ দিন আগে ওই কর্মচারীকে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার ইচ্ছা লিখিতভাবে জানাতে হবে। এই ইচ্ছা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং তা সংশোধন বা প্রত্যাহার করা যাবে না মর্মেও বিধান আছে।

প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকলেও আগামী ৪ জুলাই গভর্নর পদে যোগ দিতে গেলে আব্দুর রউফ তালুকদারের আইন লঙ্ঘন হতো। পেনশন সুবিধাও কমে যেত। সাধারণত ৩-৪ দিন বা বড়জোর এক সপ্তাহ সময় হাতে নিয়ে বড় ধরনের পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে সরকার। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আব্দুর রউফ তালুকদারকে ৪ বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে ৩ সপ্তাহ আগে। সেদিন ছিল ১১ জুন, অর্থাৎ সরকারি ছুটির দিন শনিবার।

তিনি গভর্নর হয়ে চলে আসায় শূন্য হয়ে যায় অর্থ সচিবের পদ। নতুন অর্থ সচিব পদে আগেভাগেই নিয়োগ দেওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনকে। সব ঠিকঠাক করে ঈদের ছুটির পর ১২ জুলাই প্রথম কর্মদিবসে ঘটা করে গভর্নর পদে অভিষেক হয় তার।

চাকরি বা সরকারি সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে এতো বোধ-বুদ্ধির আংশিকও ফলানো গেল না জনতা ব্যাংকের প্রভাবশালী গ্রাহকদের বিরুদ্ধে। বরং তারাই শিক্ষা দিয়ে ছাড়লেন?

হিসাব ও অংকে এতো বুঝবান গভর্নরের নিশ্চয়ই জানার বাইরে নয়, আগে ব্যাংকটির গ্রাহক ছিলেন দেশের প্রথম শ্রেণির রপ্তানিকারক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। সময়ের ব্যবধানে কিভাবে দেশের শীর্ষ খেলাপি ও প্রভাবশালীরা ব্যাংকটির বড় গ্রাহক হলেন? যদি না জেনেই থাকেন, এখন তো জানলেন?

অবশ্যই জেনেছেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৫ মাসে কোন তেলেসমাতিতে নতুন ১০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা ঋণের ৮৪ শতাংশই সৃষ্টি হয়েছে নন-ফান্ডেড দায় থেকে? কাদের কারসাজিতে ব্যাংকটি ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলে বা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে নেওয়া ঋণের দায় বৈদেশিক মুদ্রায় শোধ করেননি হিম্মতওয়ালা গ্রাহকরা? এসবের কিছু কিছু জেনেছেন বলেই তো ঋণ কার্যক্রম স্থগিতের চিঠিতে বলেছেন, এসব ঋণ স্বাভাবিক ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়নি। রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসন না হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং এই প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে অর্থ পাচার হওয়ায় ঝুঁকি রয়েছে। অর্থাৎ তার ৩ চ্যালেঞ্জ বরবাদের একটা বন্দোবস্ত মালুম করেছেন গভর্নর। সেই দৃষ্টেই তার কড়া সিদ্ধান্ত।

এর জের দেখার একটা অপেক্ষা তৈরি হয় কৌতূহলীদের মধ্যে। তাদের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দিয়ে পত্র মারফতে জানানো হয় হুকুম পাল্টানোর কথা। আর যুক্তি হিসেবে বলা হয়, পর্যাপ্ত তারল্য সংরক্ষণ সাপেক্ষ বৈদেশিক ঋণ কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা স্থগিত করা হলো। এর বেশি যুক্তি বা ব্যাখ্যা দেওয়ার কি-ই বা থাকে?  যার যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন।

বাকি থাকছে সামনের দিনগুলো দেখার। এর আগে দেখিয়েছেন ১১ নম্বর গভর্নর আরেক আমলা ফজলে কবির। হাতে গোনা কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর হাতে তিনি ব্যাংকিং খাত এমনভাবে ছেড়ে দিয়েছিলেন, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। আব্দুর রউফ তালুকদার কাকে কী বানাবেন, রুখবেন, নাকি লাগাম ছেড়ে সাক্ষীগোপাল হবেন—সেই ক্রিয়াকর্ম দেখার পালা।

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
bad loans rise in Bangladesh 2025

Bad loans hit record Tk 420,335 crore

It rose 131% year-on-year as of March of 2025

2h ago