বার্মার জীবনে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন ছিল অজস্র অভিজ্ঞতায় ঠাসা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে বার্মার জীবন।
১৯০৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১৩ বছর ৩ মাস বার্মায় কাটিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বার্মার সেই জীবন ছিল শরৎচন্দ্রের জীবনের বড় একটি অধ্যায়।
শরৎচন্দ্রের বার্মা যাত্রার খবর পুরোপুরি অজানা ছিল তার পরিবার ও বন্ধু মহলের কাছে। বাবার মৃত্যুর কারণে স্বভাবতই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। একসময় বাবার ওপর অভিমান করে সন্ন্যাসী সেজে বাড়ি ছেড়েছিলেন। আবার বাবার মৃত্যুর পর বাড়ি ফিরে বাবার শ্রাদ্ধ করলেন। এরপর চলে এলেন কলকাতায়।
কলকাতায় মামা উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ৩০ টাকা মাসিক বেতনের বিনিময়ে কাজ শুরু করেন কলকাতা হাইকোর্টের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের হিন্দি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদে।
৬ মাস সেই বাড়িতে কাটানোর পর মাত্র ৩০ টাকা বেতনে কাজ করতে আপত্তি জানান শরৎ। শেষপর্যন্ত উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার চেয়ে বলেন, 'এখানে থাকতে আমার মন চাইছে না উপেন। রেঙ্গুনে নাকি ভাগ্য ফেরে।'
সেইসময়ে রেঙ্গুনে থাকতেন শরৎচন্দ্রের এক মাসি। তার মেসো অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রেঙ্গুনের নামকরা উকিল। অন্যদিকে তিনি ছিলেন লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের ভগ্নিপতিও।
মামা উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ১৯০৩ সালের জানুয়ারিতে রেঙ্গুনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন শরৎ। রেঙ্গুন পৌঁছানোর পর শরৎকে ১০ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছিল। কারণ, তখন রেঙ্গুন জুড়ে ছড়িয়েছিল ভয়াবহ প্লেগ রোগ।
শরৎচন্দ্রের রেঙ্গুন যাত্রা ও কোয়ারেন্টিনের বর্ণনা পাওয়া যায় তার জীবনচরিতমূলক উপন্যাস 'শ্রীকান্ত'র দ্বিতীয় পর্বে। 'পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা Quarantine; তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্ণমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে এক চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়। তবে যদি কাহারও কোন আত্মীয় শহরে থাকে এবং সে Port Health Officer এর নিকট হইতে কোন কৌশলে ছাড়পত্র যোগাড় করিতে পারে, তাহা হইলে অবশ্য আলাদা কথা।'
কোয়ারেন্টিন থেকে যখন শরৎচন্দ্র ছাড়া পেলেন, তখন তার হাত পুরোপুরি ফাঁকা। অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িও তিনি চিনতেন না। তখন তিনি লোকমুখে শুনলেন, রেঙ্গুনে একটি মাত্র বাঙালি হোটেল আছে। নাম 'দাদাঠাকুরের হোটেল'। শুনেই সেখানে গেলেন শরৎ। উদ্দেশ্য বাড়ির খোঁজ পাওয়া। অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় তখন রেঙ্গুনের নামকরা উকিল বলে ঠিকানা সহজেই পেয়ে গেলেন।
মাসির বাড়িতেই বেশ ভালোভাবে দিন কাটছিল শরৎচন্দ্রের। অঘোরনাথ শরৎচন্দ্রকে রেলওয়ের অডিট অফিসে ৭৫ টাকা বেতনের অস্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
এই অঘোরনাথই একসময় শরৎচন্দ্রের বাবা মতিলাল চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, শরৎ যদি বর্মী ভাষা শিখতে পারে তবে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা নেই।
এরপর বর্মী ভাষা শিখে নেন শরৎ। কিন্তু বর্মী ভাষা শিখলেও বর্মী ভাষার উকিল হওয়ার পরীক্ষাতে পাসই করতে পারলেন না তিনি। তাই তার উকিল হওয়াটাও আর হয়ে উঠলো না। এরপরে কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান অঘোর চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্রের মাসিমা রেঙ্গুন ছেড়ে চলে যান কলকাতায়।
রেলওয়ের অডিট অফিসে ২ বছর চাকরির পর চাকরি চলে যায় শরৎচন্দ্রের। এরপর তিনি তার বন্ধু গিরীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে পেগু চলে যান এবং সেখানে অবিনাশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।
১৯০৬ সালের এপ্রিলে তার চাকরি হয় রেঙ্গুনের একটি অফিসে। তাকে চাকরি পেতে সহায়তা করেছিলেন পাবলিক ওয়ার্কস অ্যাকাউন্টস অফিসের সহযোগী পরীক্ষক মণীন্দ্রনাথ মিত্র। এরপরের ১০ বছর সেই চাকরি করেছিলেন শরৎ।
শরৎচন্দ্র থাকতেন রেঙ্গুনের বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কারখানা মিস্ত্রিদের পল্লীতে। সেখানে তিনি ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়। সবার বিপদে সবার আগে চলে যান শরৎচন্দ্র। মিস্ত্রি পল্লীর কারো সর্দি-কাশিতে হোমিওপ্যাথির ওষুধ দিতেন তিনি। জনপ্রিয়তার কারণে তার বন্ধুরা সেই মিস্ত্রি পল্লীকে ডাকতেন শরৎপল্লী বলে।
সেখানকারই এক ঘটনা। শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রি কন্যা থাকতেন তার বাসার নিচে। মেয়েটির বাবা মেয়েটির বিয়ের জন্য এক মদ্যপ পাত্র ঠিক করলে মেয়েটি শরৎচন্দ্রের কাছে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার সাহায্য চান। শরৎ কৌশলে বিয়েটি ভেঙে দিলে মেয়েটির বাবা শরৎকে সেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলেন। সেই সংসারে তাদের একটি সন্তান জন্ম নেয়। যদিও প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে শরৎচন্দ্রের সেই স্ত্রী ও পুত্র উভয়েই মারা গিয়েছিলেন।
বার্মার জীবনে ২ বার বিয়ে করেছিলেন শরৎচন্দ্র। তার দ্বিতীয় বিয়ে ছিল রেঙ্গুন নিবাসী কৃষ্ণদাস অধিকারীর চতুর্দশী কন্যা মোক্ষদা। বিয়ের পর তার নাম বদলে হিরন্ময়ী দেবী রেখেছিলেন শরৎচন্দ্র। সেই সংসারে কোনো সন্তান ছিল না তাদের।
একপর্যায়ে সাংসারিক ব্যর্থতায় শরৎচন্দ্র নিজেকে সমর্পণ করেন মদের আসরে। অনেক সময় এতো বেশি মদ্যপান করতেন যে মদের আসরেই লুটিয়ে পড়তেন।
এক রাতে তার ঘরে মদ ছিল না। মদের নেশায় গভীর রাতেই এক বাঙালি বন্ধুকে নিয়ে ছুটলেন বর্মী বন্ধুর বাড়িতে। সেখানে পৌঁছে জানলেন, অসুস্থতার কারণে মদ ছেড়ে দিয়েছেন সেই বন্ধু। কিন্তু শরৎচন্দ্রের অবস্থা দেখে বর্মী বন্ধুর স্ত্রী গোপন কুঠুরি থেকে বের করে দিয়েছিলেন মদের বোতল। স্ত্রীর কাছে মদ না খাওয়ার ওয়াদা করে আসরে যোগ দিয়েছিলেন সেই বর্মী বন্ধুও। স্ত্রী ঘুমাতে যাওয়ার সুযোগে মদ পান করেন তিনিও। কিন্তু সামলাতে না পেরে লুটিয়ে পড়েন এবং সেখানেই মারা যান। বন্ধুর এমন পরিস্থিতি দেখে মদ ছেড়ে দেন শরৎ। ধরেন নতুন নেশা, আফিম।
রেঙ্গুনে শরৎচন্দ্রের ছিল অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা। নবীনচন্দ্র সেন শরৎচন্দ্রকে 'রেঙ্গুন রত্ন' উপাধি দিয়েছিলেন। রেঙ্গুনে থাকার সময়ে শরৎচন্দ্রের মুখে ছিল ঘন দাঁড়ি ও গোঁফ। তিনি আদর্শ মানতেন প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক এমিল জোলাকে। যদিও পরবর্তীতে দেশে ফেরার পর সেই দাঁড়ি ও গোঁফ পুরোপুরি কামিয়ে ফেলেছিলেন শরৎ। বার্মায় থাকাকালীন মাছ ধরার নেশায় প্রায়ই বহু টাকা খরচ করে পেগুতে ছুটে যেতেন তিনি। তার মাছ শিকারের ভাগ্যও ছিল চমৎকার।
তবে বার্মার জীবন যে শরৎচন্দ্রের জন্য সুখকর ছিল, তা কিন্তু নয়। সেই মিস্ত্রি পল্লীতেই একবার ঘোর বিপদে পড়েছিলেন তিনি।
একবার সেখানে গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে পালান এক স্বামী। যেদিন মেয়েটির প্রসব বেদনা উঠলো, সেদিন পল্লীর মানুষ ছুটে যান শরৎচন্দ্রের কাছে। শরৎচন্দ্র ডাক্তার ডেকে আনেন, মেয়েটি সন্তান প্রসব করেন। মেয়েটির স্বামীর খোঁজে ডায়েরি করলেন শরৎ। একপর্যায়ে তার খোঁজ পাওয়া গেলে সেই মেয়েকে নিয়ে হাজির হন শরৎ। ওই ব্যক্তি মেয়েটিকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। জানা যায়, ওই ব্যক্তি অন্যত্র সংসার পেতেছে, আর সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়েও হয়নি।
তখন শরৎ সেই মেয়েকে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভরণপোষণের দাবীতে মামলা করতে বলেন। আদালতে ওই ব্যক্তি উল্টো শরৎচন্দ্রের নামে অভিযোগ করে বলেন, মেয়েটি তার স্ত্রী নয়। সন্তানটিও তার নয়, বরং শরৎচন্দ্রের। শেষপর্যন্ত অনুসন্ধান ও থানায় করা ডায়েরি দেখে বিচারক রায় দেন এবং দায় থেকে মুক্তি পান শরৎ।
রেঙ্গুনে যে বাড়িতে শরৎচন্দ্র থাকতেন, সেই বাড়িটি তিনি কিনেছিলেন এক ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। কাঠের সেই বাড়িতে ছিল শরৎচন্দ্রের নিজস্ব লাইব্রেরি।
১৯১৬ সালে আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে যায় সেই বাড়িটি। সেইসঙ্গে পুড়ে যায় তার জমানো সব টাকা, 'চরিত্রহীন' উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ও বেশ কয়েকটি পেইন্টিং।
এর কিছুদিন পরেই রোগে আক্রান্ত হন শরৎচন্দ্র। ডাক্তার তাকে দেখে বলেন, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার জন্যই এই পরিস্থিতি। সবচেয়ে ভালো হয় তিনি যদি বার্মা ছেড়ে দেশে চলে যান।
অবশ্য শরৎচন্দ্রের ছিল ভিন্ন মত। তিনি ঠিক করেছিলেন বার্মাতেই থাকবেন। তবে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যাবেন কলকাতায়। কিন্তু অফিসে ছুটি চাইতে গেলে ছুটি নিয়ে মনোমালিন্য হয় অফিসার বড় কর্তার সঙ্গে। ছুটি দিতে নারাজ সেই কর্মকর্তা। শেষপর্যন্ত সেই মনোমালিন্যের জেরে চাকরি ছেড়ে শরৎচন্দ্র ফিরে যান কলকাতায়।
শরৎচন্দ্রের বার্মা জীবনের পদে পদে ছিল রোমাঞ্চ, বিচ্ছেদ, বেদনা, হতাশা, হাহাকার, আনন্দ—সবকিছুই। বার্মা জীবনে অজস্র মানুষের সঙ্গে মিশেছিলেন শরৎ। সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা শরৎচন্দ্রের সাহিত্য জীবনকেও করেছিল পরিপূর্ণ।
সূত্র: শরৎচন্দ্র/শ্রীকানাইলাল ঘোষ; শরৎচন্দ্র/গোপালচন্দ্র রায়; শ্রীকান্ত/শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
Comments