যে আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পেলেন স্ভ্যানতে পেবো

ছবি: নোবেল প্রাইজের ফেসবুক পেজ

মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস এবং তারা কীভাবে পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সে বিষয়ে জানতে সাহায্য করায় ২০২২ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন সুইডিশ নাগরিক স্ভ্যানতে পেবো। তার গবেষণার বিষয় ছিল মানবজাতির পূর্বপুরুষ বিলুপ্ত হোমিনিনসের জিনম ও মানব বিবর্তন।
  
মানুষের উৎপত্তি কীভাবে এবং তাদের পূর্বপুরুষের সঙ্গে বর্তমান আধুনিক মানুষ কীভাবে সম্পর্কিত এই প্রশ্নগুলো সম সময় মানুষকে ভাবিয়েছে। স্ভ্যানতে পেবো তার মানব বিবর্তন সম্পর্কিত আবিষ্কার থেকে সেই কৌতূহল মেটানোর প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়েছেন।

স্ভ্যানতে পেবোর এই আবিষ্কার মানুষের বিবর্তনীয় ইতিহাস এবং কীভাবে মানুষ পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তা বের করতে সাহায্য করে। আসুন জেনে নেওয়া যাক বিলুপ্ত হোমিনিন সম্পর্কে। 

হোমিনিন কী?

প্রাণিবিদ্যার হোমিনিনি 'গোত্র' (পরিবার হোমিনিডে, অর্ডার প্রাইমেট)-এর যেকোন সদস্যকে বলা হয় হোমিনিন। বর্তমানে যার মধ্যে শুধু একটি প্রজাতি আজ বিদ্যমান- হোমো সেপিয়েন্স বা মানুষ। শব্দটি প্রায়শই মানব বংশের বিলুপ্ত সদস্যদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। যার মধ্যে বেশকিছু এখন জীবাশ্মের অবশেষ থেকে বেশ পরিচিত, যেমন: এইচ নিয়ান্ডারথালেনসিস (নিয়ান্ডারথাল), এইচ ইরেক্টাস, এইচ হ্যাবিলিস ও অস্ট্রালোপিথেকাসের বিভিন্ন প্রজাতি।

হোমো সেপিয়েন্স এবং এই বিলুপ্ত হোমিনিনদের মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে অত্যন্ত আগ্রহের একটি বিষয়।  

স্ভ্যানতে পেবো। ছবি: এপি
স্ভ্যানতে পেবোর গবেষণা

মানব বিবর্তন গবেষণার জন্য জীবাশ্মবিদ্যা এবং প্রত্নতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক ডিএনএ প্রযুক্তিগুলো আমাদের প্রাচীন অতীতকে আরও নির্ভুলতার সঙ্গে পরীক্ষা করার সুযোগ করে দেয়। তবে, হাজার হাজার বছর ধরে ডিএনএ'র অবক্ষয়, অণুজীব এবং সমসাময়িক মানুষের দূষণের ফলে সৃষ্ট চরম প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের কারণে, বিলুপ্ত হোমিনিনদের অবশিষ্ট থেকে প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে কি না তা দীর্ঘকাল ধরে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।  

সেখানে এই চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে স্ভ্যানতে পেবো নিয়ে এসেছেন সাফল্য। 

১৯৯০-এর দশকে মানুষের জেনেটিক কোডের ওপর গবেষণা চলছিল ব্যাপক গতিতে। তবে সেটা আদিম ডিএনএর তাজা নমুনার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু, অধ্যাপক পাবোর আগ্রহ ছিল মানুষের পূর্বপুরুষদের পুরানো, ক্ষয় হয়ে যাওয়া এবং দূষিত জেনেটিক উপাদানের প্রতি। অনেকে ভেবেছিলেন এটি একটি অসম্ভব কাজ। কিন্তু তিনি প্রথমবারের মতো ৪০ হাজার বছরের পুরনো একটি হাড়ের টুকরো থেকে ডিএনএ সিকোয়েন্স তৈরি করতে সক্ষম হন।

তিনি মানুষের নিকটতম বিলুপ্ত আত্মীয়, নিয়ান্ডারথালের জিনোমের ক্রম আবিষ্কারে সফল হন। নিয়ান্ডারথালরা ছিল মানুষের একটি পৃথক প্রজাতি, যারা ৪০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যায়। 

নোবেল পুরস্কার কমিটি জানায়, তিনি আমাদের বিলুপ্ত আত্মীয় নিয়ান্ডারথালের জেনেটিক কোড ক্র্যাক করার আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কাজটি করেছেন।

এ ছাড়া পাবো সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহা থেকে পাওয়া ৪০ হাজার বছর পূর্বের ছোট একটি আঙুলের হাড় থেকে পাওয়া জিনোম তথ্য থেকে আরেকটি অজানা হোমিনিন ডেনিসোভা'র বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য আবিষ্কার করেন।

হোমো সেপিয়েন্সের সঙ্গে হোমিনিনের সম্পর্ক ও এর প্রভাব

কিছু মৌলিক প্রশ্নকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে স্ভ্যানতে পেবোর কাজ। যেমন, আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং অন্যান্য হোমিনিনরা যেখানে বিলুপ্ত সেখানে হোমো সেপিয়েন্সরা কীভাবে সফল হলো?

আফ্রিকা থেকে যখন হোমো সেপিয়েন্সরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, সেই মুহূর্তে ইউরেশিয়ায় হোমিনিনদের দুটি স্বতন্ত্র দল নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভানরাও বাস করছিল।

ছবি: সংগৃহীত

স্ভ্যানতে পেবোর গবেষণা থেকে জানা যায় যে, হোমো স্যাপিয়েন্সরা সহ-অবস্থানের সময় নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভানদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। যার ফলে বর্তমান সময়ের মানুষের মধ্যে এই প্রাচীন ডিএনএ দেখা যায়।  

হোমো সেপিয়েন্সরা ডেনিসোভানদের সঙ্গে প্রজনন করে, যার কারণে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশের মানুষের মধ্যে ৬ শতাংশ পর্যন্ত ডেনিসোভান ডিএনএ পাওয়া যায়।

অন্যদিকে নিয়ান্ডারথাল এবং বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে ডিএনএ'র আরও কিছু তুলনা থেকে জানা যায় যে, হোমো সেপিয়েন্সরা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে প্রজননের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দিয়েছিল।

যার প্রভাব বর্তমান মানুষের মধ্যে দেখা যায়। বর্তমানে আধুনিক মানুষের ১ থেকে ৪ শতাংশ ডিএনএ তাদের নিয়ান্ডারথাল আত্মীয়দের কাছ থেকে আসা।

বর্তমান যুগের আধুনিক মানুষের মধ্যে এই ডিএনএ'র মিশ্রণের শারীরবৃত্তীয় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই ডিএনএ মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং বিভিন্ন সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। 

পাবোর যুগান্তকারী আবিষ্কার মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। প্রাচীন হোমিনিনের মধ্যে মিশ্রণ সম্পর্কিত আবিষ্কারটি বিবর্তনের একটি অপ্রত্যাশিত জটিলতা প্রকাশ করে। সেইসঙ্গে আবিষ্কারটি আমাদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য একটি উন্নত ভিত্তি প্রদান করে। যা মানুষ অন্যান্যদের থেকে কেনো অনন্য সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়।

 

তথ্যসূত্র: নোবেল প্রাইজ.ওআরজি, বিবিসি, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা

 

Comments

The Daily Star  | English

Govt plans to hire foreign firms to operate Ctg Port: Shafiqul

He expressed hope that the recruitment process would be completed by September this year

2h ago