‘তরুণ প্রজন্মকে আজ জানতে হবে আমরা মুক্তিযুদ্ধ কেন করেছিলাম'

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো আবু মুছা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুছা চৌধুরী নাগরিক শোকসভা কমিটির আয়োজনে একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: স্টার

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডো আবু মুছা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। 

মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুছা চৌধুরী নাগরিক শোকসভা কমিটির আয়োজনে একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুছা চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত করার দাবি জানানো হয়েছে।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, 'আবু মুছা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি অপারেশন জ্যাকপট, অপারেশন আউটার অ্যাংকর, অপারেশন অ্যাভলুজ ছাড়াও বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, নারায়ণগঞ্জের নিকটে জাতিসংঘের পণ্যবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'তরুণ প্রজন্মকে আজ জানতে হবে আমরা মুক্তিযুদ্ধ কেন করেছিলাম। পাকিস্তান হয়েছিল বাঙালির ভোটে। অথচ আমাদের বাংলা ভাষার দাবিকেই তারা অস্বীকার করেছিল। তাই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু মুক্তি সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পরও তারা আমাদের ক্ষমতা দেয়নি।'

মুক্তিযুদ্ধে নৌ কমান্ডোদের পরিচালিত অভিযানের গুরুত্ব তুলে ধরে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, 'তাদের গোপনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট তারা একযোগে ১১টি জাহাজ উড়িয়ে দেয়। এই প্রথম পাকিস্তান বিশ্বের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয় মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এর আগে পর্যন্ত তারা মিথ্যাচার করছিল। নৌ কমান্ডোদের অভিযানের পর আর বিশ্বের কাছে মিথ্যাচার করতে পারেনি।'

'জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া, এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া মিলে ২৯ বছর ক্ষমতায় ছিল। আর আমরা ২২ বছর। ২৯ বছরে তারা দেশের কোনো উন্নতি করেনি। কারণ তারা চায়নি এ দেশ স্বাধীন হোক। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশও পাকিস্তানের মত ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্র হোক। গত কিছুদিনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২ বার বলেছেন, এর চেয়ে পাকিস্তান ভালো ছিল। কোন দিক দিয়ে ভালো ছিল?', বলেন তিনি।

মন্ত্রী আরও বলেন, 'বিশ্বে বাংলাদেশ আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের রোল মডেল। আর তারা বলে পাকিস্তান ভালো ছিল। আসলে পাকিস্তানের ভূত তাদের মাথা থেকে যায়নি। এসব মিথ্যাচার শুনলে আজও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, শহীদদের আত্মার অসম্মান হয়। তাদের মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট। বাংলাদেশে থেকেও তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারে না। এদের যাতে রাজনৈতিক কবর রচিত হয় সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।'

সভায় সভাপতির বক্তব্যে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, 'রাজধানী হওয়া উচিত ছিল ঢাকায় হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। কিছুই হলো না পূর্ব পাকিস্তানে। এমনকি ভাষাকেও চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলো। একারণে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধাদের কত ত্যাগ, অবদান। জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন উৎসর্গ করতে ছুটে গিয়েছিলেন আবু মুছা চৌধুরী।  দেখতে হবে সত্যিকার অর্থে কারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে  যে গণহত্যা তার আন্তর্জাতিক স্কীকৃতি আজো মিলেনি। বাংলাদেশকে প্রথম স্বাধীনতা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর দেশকে আজ এক সমৃদ্ধির স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। সমস্ত বাঙালির চিত্ত জয় করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।'

সভায় প্রধান বক্তা নৌ কমান্ডো অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অনিল বরণ রায় বলেন, 'পাকিস্তানিরা স্বীকারই করছিল না এখানে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু নৌ কমান্ডোদের অপারেশনের কারণে তাদের স্বীকার করতে হয়। সারাবিশ্বে জানতে পারে এখানে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আবু মুছা চৌধুরী খুব সাহসী যোদ্ধা ছিলেন।'

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, 'মুছা চৌধুরীর চিকিৎসার খরচ পারিবারিক ভাবে ও বন্ধুদের উদ্যোগে মেটাতে হয়েছে। অপারেশ অ্যাভলুজে যাবার সময় ছোড়া গ্রেনেডে তিনি আহত হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় মুছা চৌধুরীর অপারেশন বিষয়ে জানলে উনাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব দিবেন। মন্ত্রীকে অনুরোধ করবো বিবেচনার জন্য। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করে, এটা অবাক করা বিষয়। তাদের এই কাজে রাখা অনৈতিক। স্থায়ী বাছাই কমিটি কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডার বা জীবিত সদস্যদের দিয়ে করতে হবে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের শাখা জেলা উপজেলায় করতে পারেন।'

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাহিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'যুদ্ধ করে স্বাধীন যদি হই, ৩০ লাখ শহীদ যদি হই, তাহলে এ সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে পৌঁছে দিতে হবে। দেশের কোনো সংকটের মুহূর্তে নতুন প্রজন্মই ঘুরে দাঁড়াবে। তাই তাদের ইতিহাস সচেতন হতে হবে।'

নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জানতে হলে বাঙালির ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের ইতিহাস জানতে হবে। নৌ কমান্ডো আবু মুছা চৌধুরী জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভাই হারিয়েও সেদিন যুদ্ধে গিয়েছিলাম সেদিন। কত রক্তের বিনিময়ে আমার দেশ মাতৃকা মুক্ত হয়েছে। আজ শ্বাপদ আবার থাবা দিচ্ছে। তাই শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সব হারিয়ে একটি দেশ একটি পতাকা একটি সংবিধান একজন নেতা পেয়েছি আমরা। আমরা যারা বেঁচে আছি কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান চাই না। কোনো জঙ্গিবাদ চাই না। মুক্তির যুদ্ধ থামেনি। যতদিন আমরা বেঁচে থাকব ততদিন আমাদের লড়াই চলবে।'

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেম বলেন, 'বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুছা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রেখেছেন। শুধু যুদ্ধে নয় মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববতী আন্দোলন সংগঠনেও সক্রিয় সংগঠক ছিলেন তিনি।'

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম কণ্ঠস্বর রাখাল চন্দ্র বণিক বলেন, 'বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করবেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। এ ঘোষণা আমি দিয়েছিলাম। এটা ছিল জনযুদ্ধ। বীরত্বের গুরুত্ব যদি নির্ধারণ করতে না পারি তাহলে ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকবো। নগর, গ্রামের রাস্তা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করা উচিত। আবু মুছা চৌধুরীরা যুদ্ধের পরও ৫০ বছর লড়াই করেছেন, কিছু পাওয়ার জন্য নয়। সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার দায়িত্ব সরকারের। মুক্তিযুদ্ধকে মানুষের কাছে সঠিকভাবে নিতে হবে। আমরা থাকব না। মুক্তিযুদ্ধ থাকবে।'

নৌ কমান্ডো বদিউল আলম শাহ বলেন, 'যুদ্ধ ৯ মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল না। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর খাদ্য ও রসদ বন্ধ করতে দেশের বন্দরগুলো অচল করা প্রয়োজন ছিল। চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জসহ গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো বন্ধ করা। সেজন্যই অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনা করি।'

নৌকমান্ডো মো. আনোয়ার মিয়া বলেন, 'পলাশীর মাঠে একইসাথে একই ক্যাম্পে ছিলাম আবু মুছা চৌধুরীর সাথে ১৯৭১ সালে। উনার সাথে আমিও নির্বাচিত হই চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশ জ্যাকপট পরিচালনার জন্য।' 

মঙ্গলবার সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুছা চৌধুরীর স্মরণে স্মারক গ্রন্থের পাঠ উন্মোচন করেন অতিথিরা।

Comments

The Daily Star  | English
quota reform movement,

Govt publishes preliminary list of those killed in July-August protests

The interim government today published a preliminary list of the people who died during the student-led mass protests in July and August.

1h ago