স্যোশাল মিডিয়া-ওটিটি নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়ায় লোকদেখানো মতামত গ্রহণ

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) তাদের নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়ার বিষয়ে মতামত জানতে চেয়েছিল, তবে চূড়ান্ত সংস্করণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে এর প্রধান প্রধান অংশীজনদের মতামতের খুব সামান্যই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

আইন প্রণয়ন কমিটি তাদের খসড়াটি চূড়ান্ত করার সময় শেষ যে ৩টি অধিবেশন করে তার কার্যবিবরণী গত বুধবার হাইকোর্টে জমা দিয়েছে বিটিআরসি। বিবরণীতে বলা হয়েছে, অংশীজনরা যে গুরুত্বপূর্ণ মতামতগুলো দিয়েছেন তা গ্রহণ করা তো দূরের কথা, আলোচনাও করা হয়নি। 

একই দিনে 'ডিজিটাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বিটিআরসির আইনের' চূড়ান্ত খসড়াটি  হাইকোর্টে জমা দেওয়া হয়।

চূড়ান্ত খসড়ায় সরকারকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাতে কোনো ব্যক্তিকে তার কনটেন্ট নামিয়ে নিতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে কোনো কনটেন্ট ব্লক করতে আদেশ দিতে পারবে এবং এই আইনের আওতায় তার কাজের জন্য দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে।     

গত কয়েক মাস ধরে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে স্বোচ্চার হলেও সরকার মতপ্রকাশের সুযোগ সংকুচিত করে যাচ্ছে। 

ব্লাস্ট তাদের সুপারিশে বিটিআরসিকে বলেছে, 'অনলাইনে কনটেন্ট তৈরি এবং প্রচারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ- মত প্রকাশের অধিকার এবং এ বিষয়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠি এবং তাদের সমস্যার বিষয়ে আলোচনা ও গণতান্ত্রিক বিতর্কের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।'

ব্লাস্টের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, 'যে প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কনটেন্ট অপসারণে মধ্যস্থতাকারী প্রয়োজন, সেটি  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু বিধানের অনুরূপ। ইতোমধ্যে যেটিকে অনেকে নির্বিচারে বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।'

এর মধ্যে যে বিষয়গুলোর উল্লেখ রয়েছে তা হলো, যা 'বাংলাদেশের ঐক্য, অখণ্ডতা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব (এবং দেশের) বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে হুমকিতে ফেলে' অথবা 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির জনক, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরোধী' এবং 'সরকারের গোপনীয়তাকে হুমকিতে ফেলে' বা 'অশান্তি বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করে' বা 'জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকিস্বরূপ'।

টিআইবি জানিয়েছে, যেসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মধ্যস্থতাকারী, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে স্থানীয়ভাবে নিবন্ধন করতে হবে এবং তাদের কর্মকাণ্ড নিয়মের পরিপন্থী হলে বিটিআরসিকে নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে নজরদারির মধ্যে রাখা হবে এবং তারা বাংলাদেশে কাজ করতে নিরুৎসাহিত হবে। 

এ ছাড়া বিবরণীতে বেশ কিছু উদ্বেগের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি এবং চূড়ান্ত খসড়ায় সেগুলো রাখা হয়েছে। 

হাইকোর্টে বিটিআরসির দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত, বিবেচনা এবং মূল্যায়েনের পর আইনটি চূড়ান্ত করা হবে।'

তা সত্ত্বেও অংশীজনদের মতামতগুলো মূল্যায়নের প্রতিশ্রুতি বিবরণীতে প্রতিফলিত হয়নি। 

গত ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ অধিবেশনে 'কনটেন্ট', 'ডিজিটাল ডিভাইস', 'ইন্টারমিডিয়ারি' ও 'কিউরেটেড কন্টেন্ট' এ জাতীয় শব্দের সংজ্ঞা পর্যালোচনা করে কমিটি।

এর ২ সপ্তাহ পরে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর কমিটি তাদের দ্বাদশ অধিবেশনের আয়োজন করে। সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়, যে কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে নিবন্ধিত তাদের আর নিবন্ধনের দরকার নেই। তবে, এর প্রয়োজনীয়তা বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়নি। 

এই বৈঠকে তারা গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভের (জিএনআই) একটি মতামত গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জিএনআই-এর সদস্যদের মধ্যে আছে, মেটা, মাইক্রোসফ্ট, উবার, জুম, টেলিনর গ্রুপ, ইয়াহু, গুগল, নোকিয়া, ভোডাফোন, ভেরিজন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, উইকিমিডিয়া, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। 

এ আইন লঙ্ঘনের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের যে অতিরিক্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে; ৩ বিলিয়ন টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড- সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভ।

দ্বাদশ বৈঠকে কমিটি ফৌজদারি দায়ের বিষয়টি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এর পরিবর্তে করপোরেট দায় অন্তর্ভুক্ত করে। সবশেষ খসড়ায় আইন লঙ্ঘন করলে জরিমানার বিধান অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে কিন্তু পূর্ববর্তী খসড়াগুলোতে উল্লিখিত সীমা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে কেবল এ কথা যোগ করা হয়েছে যে, 'জরিমানা অত্যধিক হওয়া উচিত নয়।'
 
এ ছাড়া দ্বাদশ অধিবেশন চলাকালীন কমিটি পূর্ববর্তী খসড়ার সেই অংশটি বাদ দেয়, যেখানে কোম্পানিগুলোকে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন অপশন বাদ দিতে এবং পাঠানো বার্তার 'ফার্স্ট অরিজিনেটর' বা প্রথম পোস্টকারীকে শনাক্ত করতে বাধ্য করার কথা উল্লেখ ছিল। 

এর ১০ দিন পরে ১৩তম বৈঠকে কমিটির মূল উদ্বেগের বিষয়গুলো বাদ দিয়ে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়।

আশিস কুমার কুন্ডু, মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং) যিনি সভার কার্যবিবরণীতে সই করেছেন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খসড়াটি চূড়ান্ত হওয়ার আগে অনেক অংশীজনের সঙ্গে দেখা করে তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল।'

বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

 

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

7h ago