শাউট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের অদ্ভুত নিয়ম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। ছবি: অর্কিড চাকমা/স্টার

বই পড়ার চেয়ে সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখতেই আমার বেশি ভালো লাগে। তাকগুলোতে সাজিয়ে রাখা সারি সারি বইয়ের দিকে তাকালে সেগুলোর মলাট, রঙ, সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। বইয়ের রাজ্যে হেঁটে বেড়ানোর মতো আনন্দ আর যেন কিছুতেই পাই না।

আমার মতো মানুষের জন্যই সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার এভাবে বইয়ের রাজ্যে ঘুড়ে বেড়ানোকে নিষিদ্ধ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীদের সরাসরি বইয়ের তাক থেকে বই দেখা, সেখান থেকে বই দেখে তারপর কোনোটা খুঁজে নেওয়ার অনুমতি নেই। এটা জেনে বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম। অবিশ্বাস্য, কিন্তু এটাই সত্য।

সম্প্রতি গিয়েছেলাম ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর দুটি দরজা আমার সামনে। একটি চলে গেছে শিক্ষার্থীতে পূর্ণ পাঠকক্ষে, অপরটি আমার প্রিয় বইয়ের রাজ্যে। খুব ইচ্ছে করছিল বইয়ের রাজ্যে ঢুকে যেতে। কিন্তু, সেটা সম্ভব না। দরজার সামনে একটি টেবিল। টেবিলটার আকৃতি ঠিক যেন একটা ঘোড়ার ক্ষুরের মতো। টেবিলের পিছনে, ঠিক মাঝখানে, একজন বসেছিলেন।

আমি ও আমার সঙ্গে থাকা বন্ধুরা ভেতরে গিয়ে বইগুলো দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করতে তার কাছে গেলাম।

আমাদের কথা শুনে তিনি যেন বিষম খেলেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে এমন আবদারও কেউ করতে পারে।

আবারও যখন অনুনয় করলাম, তখন তিনি আবেগ ঝেড়ে ফেলে বললেন, 'না, ভেতরে যাওয়া যাবে না। যদি কোনো বিশেষ বই দরকার হয় সেটা লিখে দেন, আমি এনে দিচ্ছি।'

ফ্যানের বাতাসে তার সামনের টেবিলে থাকা কাগজের টুকরোগুলো তখনও যেন আমাকে ডেকে বলছে, এই গ্রান্থাগারে আমাদের গুরুত্ব কমাতে চাচ্ছ?

মনে পড়ল, এই গ্রন্থাগারে এবারসহ আমি মাত্র ২ বার এসেছি। অথচ, ৩ বছর ধরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যারা মনের খোড়াক যোগাতে ঢাকার হাতে গোণা কয়েকটি বইয়ের দোকানে ঘুরে বেড়ান, তাদের কাছে এটা বেশ অদ্ভুত মনে হবে।

আমাদের প্রথম সেমিস্টারের প্রথম সপ্তাহে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে গিয়েছিলাম। আমার সেই উচ্চ প্রত্যাশা চূর্ণ করে দেয় সেখানকার দুর্গন্ধ। টয়লেট থেকে আসা সেই দুর্গন্ধে আমার অবস্থা দেখার মতো হয়েছিল। আপনিও যদি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে থাকেন, তাহলে বাজি ধরে বলতে পারি, এই অভিজ্ঞতা আপনারও হয়েছে। এরপর আর যাওয়া হয়নি। মাঝে তো করোনা মহামারি শুরু হয়ে গেল। সেই অভিজ্ঞতা আর মহামারির প্রভাবে গ্রন্থাগারে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সম্পর্কে নিজের এমন অভিজ্ঞতায় আমার আগ্রহ জন্মে অন্যদের অভিজ্ঞতা জানতে।

আমার বন্ধু আনিকা শচি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। জানতে চাইলাম, সে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যায় কি না। তার উত্তর ছিল, না। তার বিভাগের গ্রন্থাগারে তার প্রয়োজনীয় সব বই আছে।

আগ্রহ নিয়ে জানতে চাই, ইংরেজি বিভাগের গ্রন্থাগার থেকে সে নিজের হাতে বই বেছে নিতে পারে কি না। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, 'অবশ্যই!'

উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউশন এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীও জানান, তারা সাধারণত কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যান না। নিজেদের বিভাগের গ্রন্থাগারগুলো থেকেই তারা প্রয়োজনীয় বই বেছে নেন।

জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে তাকগুলোতে সাজিয়ে রাথা সারি সারি বই। ছবি: অর্কিড চাকমা/স্টার

প্রশ্ন জাগে, বেশিরভাগ বিভাগের শিক্ষার্থীরা যদি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে না-ই যায়, তাহলে সেখানে এত চাপ কেন? কেন সেখানে বসার জায়গা পাওয়া যায় না?

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের টেবিলে থাকা বইগুলো দেখে মনে হতে পারে, বিসিএসের প্রস্তুতিমূলক পড়াশুনার জন্যই হয়তো তারা সেখানে ভীড় করেন। কিন্তু তারপরও আমার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছিল, নিজ হাতে বই নিতে না পেরেই হয়তো শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বিমুখ হচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে কথা বলেছি ৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তারা জানান, গ্রন্থাগার থেকে বই বেছে নিতে না পারার বিষয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থী প্রমিতি কর্মকার বলেন, 'বইগুলো নিরাপদ রাখতে এই নিয়ম করা হয়েছে। এটা দরকার ছিল। এ ছাড়া, এত বইয়ের মাঝে নিজে থেকে বই খুঁজে বের করাও বেশ কঠিন কাজ।'

তথ্য কেন্দ্র থেকে জানায়, নিরাপত্তার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারা আরও জানায়, শিক্ষার্থীদের যদি নিজেরাই বই খুঁজতে থাকেন, তখন বইয়ের তাকগুলো সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে যাবে। তেমনটি হলে, চাহিদা অনুযায়ী বই খুঁজে পাওয়া আর সম্ভব হবে না।

তাদের এই কারণটি হাস্যকর মনে হলো। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনার জন্য একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেন, 'নিরাপত্তার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে বই ধরতে না দেওয়ার যুগ এখন আর নেই। অন্যান্য গ্রন্থাগারে যদি সিসিটিভি এবং ঠিক জায়গায় বই রাখতে আরএফআইডি (রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন) ট্যাগ থাকতে পারে, তাহলে আমাদের গ্রন্থাগারে সেটা কেন ব্যবহার করা হয় না?'

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের যে পদ্ধতি, তা জ্ঞান অন্বেষণের জন্য সংকীর্ণতা তৈরি করছে। সব বই একজন লাইব্রেরিয়ান লিখে দেওয়া স্লিপ দেখে আনতে পারেন না। শুধুমাত্র শিক্ষক বলে দিয়েছেন বা পাঠ্যক্রমে আছে বলেই আমরা বই পড়ি, তা নয়। অনেক সময় আমরা বই বেছে নেই তার নাম দেখে, প্রচ্ছদ দেখে, লেখকের নাম দেখে, কিংবা এমনই অনেক কারণে। কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও একটি বই চোখে পরলে মনে হতেই পারে যে এটা পড়া দরকার। যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বর্তমানে পদ্ধতিতে সম্ভবই না।

বই যে কক্ষে আছে সেই কক্ষের প্রবেশ পথ আটকানো টেবিল দিয়ে, কাঠের ছোট্ট দরজায় ঝুলছে তালা। 'শিক্ষাই আলো' নীতিবাক্য নিয়ে এগিয়ে চলা একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণে বিরত রাখা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের অবাধে জ্ঞান অন্বেষণে বাধা দেয়, এমন নিয়ম তৈরি করে এই গ্রন্থাগার যা করছে তা হলো, জ্ঞানের প্রদীপ ও শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি পর্দা তৈরি করে দিয়েছে। যাতে করে তারা আধো আলো, আধো অন্ধকারে থাকে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো গ্রন্থাগার থেকে এটা মোটেই প্রত্যাশিত না। এই গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বই নেই বলেও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তাতে কী? বইয়ের সংখ্যায় কি আসে যায়, যেখানে কোন বই আছে তা দেখার সুযোগই আমার নেই?

নওশীন নূরী; [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Govt publishes gazette of 1,558 injured July fighters

Of them, 210 have been enlisted in the critically injured "B" category, while the rest fall under the "C" category of injured fighters

6h ago