ইতালির তুরিনে ১২তম সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ সম্মেলন

‘টাকা তৈরির পৃথিবী’র স্থলে ‘৩ শূন্যের পৃথিবী’ গড়ার আহ্বান ড. ইউনূসের

বর্তমান ‘টাকা তৈরির পৃথিবী’র স্থলে একটি ‘৩ শূন্যের পৃথিবী’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান 'টাকা তৈরির পৃথিবী'র স্থলে একটি '৩ শূন্যের পৃথিবী' গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ইতালির তুরিনে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম কফি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লাভাজা'র সম্মেলন কেন্দ্রে ১২তম বৈশ্বিক সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান তিনি। 

সেসময় ড. ইউনূস তার '৩ শূন্যের পৃথিবী'র ধারণা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। এই পৃথিবী হলো- শূন্য নীট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও শূন্য বেকারত্বের একটি পৃথিবী।

এর আগে, তিনি বৈশ্বিক সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।

বিশ্বের ৫টি মহাদেশের ৪৫টি দেশের ৫০টি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫০০ জন অংশগ্রহণকারী সশরীরে এই সম্মেলনে যোগ দেন। বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আগত এই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩০০ জন ছিলেন সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তা। অন্যদের মধ্যে ছিলেন রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্র এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এবং প্রতিনিধিরা। এ ছাড়াও, আরও প্রায় ১ হাজার জন অংশগ্রহণকারী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনলাইন প্লাটফর্মে এই সম্মেলনে যোগ দেন।

বৈশ্বিক সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ সম্মেলন সামাজিক ব্যবসা বিষয়ক পৃথিবীর দুটি বৃহত্তম বার্ষিক আয়োজনের একটি, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ, সমর্থক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়ে থাকেন।

তুরিন নগরীর মেয়র স্টেফানো লো রুশো তার বক্তব্যে বৈশ্বিক সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ সম্মেলনের অনুষ্ঠানস্থল হিসেবে ঐক্যবদ্ধ ইতালির ঐতিহাসিক রাজধানী তুরিনকে বেছে নেওয়ার জন্য সম্মেলনের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান।

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন তুরিন চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারি জেনারেল ড. গুইদো বোলাত্তো, সান পলো ফাউন্ডেশন কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সেসকো প্রফুমো, লাভাজা গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট গিউসেপ্পে লাভাজা, ওয়ান ইয়ং ওয়ার্ল্ড'র প্রতিষ্ঠাতা কেট রবার্টসন এবং লুক্সেমবার্গের গ্রান্ড ডাচেজ মারিয়া টেরেসা। তারা প্রত্যেকেই বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামো কর্তৃক সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে সামাজিক ব্যবসার প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষভাবে জোর দেন।

এ বছরের শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী শান্তির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় সামাজিক ব্যবসার ভূমিকার ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়।

বৈশ্বিক সামাজিক ব্যবসা শীর্ষ সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

শীর্ষ সম্মেলনের আলোচনা ও অনুষ্ঠানসমূহ কেন্দ্রীভূত ছিল প্রধানত দারিদ্র বিমোচন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন থেকে পৃথিবীকে রক্ষা, সমাজ ও মানুষের উপকারকারী বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা এবং একইসঙ্গে মানুষের জন্য ক্ষতিকারক প্রযুক্তিগুলো বর্জনের ওপর। অ্যাকাডেমিয়া কর্তৃক সৃষ্ট ধারণা ও আইডিয়াপ্রসূত প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের যে ক্ষতি করছে, সে বিষয়ে তাদেরকে সচেতন করা, সামাজিক ব্যবসার চর্চাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বিশ্বব্যাপী তরুণ সমাজের দ্বারা সৃষ্ট 'থ্রি জিরো' ক্লাবগুলোর শক্তি ও সক্ষমতা পরীক্ষা করাও সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।

সম্মেলনের প্রথম দিনে তুরিন বিশ্ববিদ্যালয় ইউনূস সেন্টারের সঙ্গে যৌথভাবে সামাজিক ব্যবসা অ্যাকাডেমিয়া ফোরামের আয়োজন করে।

২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তা, সামাজিক ব্যবসার সমর্থক, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষক ও ছাত্রদের সশরীর উপস্থিতিতে এটিই প্রথম সামাজিক ব্যবসা সম্মেলন।

ড. ইউনূস তুরিনে পৌঁছানোর পর সেরমিগ'র প্রতিষ্ঠাতা আর্নেস্টো অলিভেরো তাকে অভ্যর্থনা জানান এবং তিনি ও তার সহকর্মীরা সামাজিক ব্যবসা নিয়ে যে কাজ করছেন, তা ড. ইউনূসকে অবহিত করেন।

আর্নেস্টো অলিভেরো, তার স্ত্রী মারিয়া সেরাতো এবং তাদের কয়েকজন বন্ধু মিলে সেরমিগ প্রতিষ্ঠা করেন, যার লক্ষ্য ছিল ক্ষুধা দূর করা এবং আলোচনা, আতিথেয়তা ও শান্তি উৎসাহিত করা। তারা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি অস্ত্র কারখানাকে 'শান্তি ও ভালোবাসার কারখানায়' রূপান্তরিত করেন। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি গৃহহীন মানুষ, ভেঙে যাওয়া পরিবার এবং অসহায় নারীকে আশ্রয় ও খাবার দিয়ে চরম আর্থ-সামাজিক দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করেছে এবং অভুক্ত মানুষদের এ পর্যন্ত ৩ কোটির বেশি খাবার সরবরাহ করেছে।

ড. ইউনূসের তুরিন আগমন উপলক্ষে বিশ্বের বৃহত্তম কফি কোম্পানি লাভাজা'র মালিক পরিবার একটি পারিবারিক ডিনারের আয়োজন করে। পরিবারটি সামাজিক ব্যবসায় জড়িত হয়েছে এবং তারা এ ব্যবসায় তাদের সফলতা পরীক্ষা করে দেখতে বিশেষভাবে আগ্রহী।

সম্মেলনের পর ড. ইউনূস কলম্বিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, যেখানে তিনি কয়েকটি সামাজিক ব্যবসা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করবেন। এ ছাড়াও, তিনি তার কলম্বিয়া সফরে সে দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করবেন, যারা এরইমধ্যে তাদের নিজ নিজ ক্যাম্পাসে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সামাজিক ব্যবসার ওপর কোর্স ও ডিগ্রী প্রদান করছে।

Comments