শেষ ওভারের নাটকীয়তায় ভারতকে হারিয়ে সিরিজ বাংলাদেশের 

প্রথম বলটা ডট দিলেও পরের দুই বলে টানা দুটি চার। এর পরের বলটি ডট হলেও পঞ্চম বলে আসে ছক্কা। জিততে হলে শেষ বলে আরও একটি ছক্কা চাই ভারতের। শেষ বলটা অসাধারণ এক ইয়র্কার করেন মোস্তাফিজুর রহমান। এবার কোনো মতে ব্যাটে লাগাতে পেরেছেন আঙুলে চোটে নয় নম্বরে খেলতে নামা রোহিত শর্মা। তাতে আরও একটি নাটকীয় জয়ের উল্লাসে মাতে বাংলাদেশ। 

বুধবার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে ভারতকে ৫ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ফলে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জিতে নিল টাইগাররা। এই নিয়ে ভারতের বিপক্ষে দুটি ওয়ানডে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে সর্বশেষ সিরিজটিও জিতেছিল বাংলাদেশ।  প্রথমে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৭১ রান তোলে স্বাগতিকরা। জবাবে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৬৬ রান করতে পারে ভারত। 

আঙুলের চোটে রোহিতের ব্যাট করতে নামা ছিল অনিশ্চিত। তবে দলের চরম খারাপ পরিস্থিতি দেখে আঙুলে ব্যান্ডেজ পরে গ্লাভস কেটে নেমে পড়েন তিনি। 

২০৭ রানে যখন সপ্তম উইকেট পড়ে যায়, তখন ক্রিজে আসেন রোহিত। এরপর খেলেন ঝড়ো এক ইনিংস। সহজ জয়ের পথে থাকা বাংলাদেশ তার ব্যাটে পড়ে গিয়েছিল দোলাচলে। শেষ পর্যন্ত মোস্তাফিজ তার কাটারের মুন্সিয়ানায় ধরে রাখেন স্নায়ু। ইবাদত হোসেন ও এনামুল হক বিজয়ের দুটি ক্যাচ মিসের হতাশা দূর করে দলকে তীরে ভেড়ান নিরাপদে। রোহিতের ২৮ বলে ৫১ রানের ইনিংসটি থেকে যায় বৃথা।

তবে কাজের কাজটা এর আগের ওভারেই করেছিলেন মোস্তাফিজ। ১৮তম ওভারে কোনো রানই দেননি। তাতে বাড়ে চাপ। শেষ দুই ওভারে ভারতের তখন প্রয়োজন ছিল ৪০ রানের। মাহমুদউল্লাহর করা ১৯তম ওভারে ২০ রান তুলে নেন রোহিত। কিন্তু ক্যাচ তুলেছিলেন দুইবার। প্রথমবার বলের লাইনেই যেতে না পেরে মিস করেন মোস্তাফিজ। পরেরবার একেবারে জায়গায় দাঁড়িয়ে সহজ ক্যাচ ফেলে দেন এনামুল হক বিজয়।

শেষ দিকে নানা নাটকীয়তা হলেও জয়ের মূল নায়ক এদিন মেহেদী হাসান মিরাজ। খাঁদের কিনারা থেকে মোস্তাফিজকে নিয়ে প্রথম ওয়ানডেতে এনে দিয়েছিলেন নাটকীয় এক জয়। দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও খাঁদের কিনারা টেনে তুলেছেন বাংলাদেশকে। প্রথমে ব্যাট হাতে। ব্যাটারদের আসা-যাওয়ার মিছিলে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে গড়েন লড়াইয়ের পুঁজি। এরপর বল হাতে থামিয়েছেন ভারতীয়দের প্রতিরোধ। ভেঙেছেন জুটি।

এদিন শ্রেয়াস আইয়ার ও আকসার প্যাটেল যখন ব্যাটিং করছিলেন তখন লড়াইটা বেশ জমিয়ে দিয়েছিল ভারত। তখনও বাংলাদেশের ত্রাতা হয়ে আসেন মিরাজ। এর আগে লোকেশ রাহুলকে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। আর ব্যাট হাতে তো দুর্দান্ত। তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসেই লড়াইয়ের পুঁজি পায় বাংলাদেশ। ব্যাটে-বলে এমন অনন্য পারফরম্যান্সের পর স্বাভাবিকভাবেই তাই ম্যাচসেরাও মিরাজ।

লক্ষ্য তাড়ায় ওপেনিংয়ে অধিনায়ক রোহিতকে পায়নি ভারত। ফিল্ডিংয়ে বুড়ো আঙুলে চোট পাওয়ায় ওপেন করতে নামেন বিরাট কোহলি। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই তার উইকেট পেয়ে যায় বাংলাদেশ। ভারতের সেরা ব্যাটার ইবাদত হোসেনের বল টেনে খেলতে গিয়ে হয়ে যান বোল্ড। ৬ বল খেলে কেবল ৫ রান করেন কোহলি।

মোস্তাফিজ পরের ওভারেই ফিরিয়ে দেন আরেক ওপেনার শিখর ধাওয়ানকে (৮)। তার আচমকা লাফানো বলে হচকচিয়ে পয়েন্টে সহজ ক্যাচ দেন এ বাঁহাতি। ১৩ রানে দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যাওয়া ভারত চারে নামিয়ে দিয়েছিল ওয়াশিংটন সুন্দরকে। এই অলরাউন্ডারও দলের ভরসা হতে পারেননি।

শ্রেয়াস আইয়ারের সঙ্গে মিলে জুটি গড়ার চেষ্টা চালালেও দশম ওভারে তাকে ফেরান সাকিব। তার বলে অনসাইডে পুশ করতে গিয়ে মিড উইকেটে লিটনের হাতে ধরা দেন ১১ রান করা সুন্দর। এরপর রাহুলকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছিলেন শ্রেয়াস। তাদের জুটি জমে উঠার আভাস দিতেই নিভেছেন রাহুল। ভারতের সহ-অধিনায়ক মিরাজের বলে আউট হন দৃষ্টিকটুভাবে।

মিরাজের সোজা বল জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট আড়াআড়ি করে দেন, অনেকটা আয়েশি ভঙ্গি থাকায় বল তাকে পরাস্ত করে। ২৮ বলে ১৪ রান করে ফেরেন রাহুল। ভাঙে ৫১ বলে ২৬ রানের জুটি। ৬৫ রানে ভারত হারায় ৪ উইকেট।

পঞ্চম উইকেটে ঘুরে দাঁড়ানোর দারুণ জুটি গড়েন শ্রেয়াস ও আকসার। ওভারপ্রতি রান তোলার চাপও কমিয়ে দিচ্ছিলেন তারা। এই দুজনের জুটির সময় চিন্তা বাড়ছিল বাংলাদেশের।

শ্রেয়াস দিচ্ছিলেন সেঞ্চুরির আভাস। মিরাজের বলে ওয়াইড লং অন দিয়ে উড়িয়ে ছক্কা মারার পর বেশ জুটি পেরিয়ে গিয়েছিল শতরান। পরে ওই ওভারে এমন আরেকটি শটের চেষ্টায় যান। তবে এবার টাইমিং হয়নি। আকাশে উঠা বল বাউন্ডারি লাইনে নিরাপদে লুফে নেন আফিফ হোসেন।

১০১ বলে ভেঙে যায় ১০৭ রানের জুটি, খেলায় ফিরে আসে বাংলাদেশ।

আকসার তবু পথের কাঁটা হয়ে টিকে ছিলেন। ৫০ বলে তুলে নিয়েছিলেন ফিফটি।

বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং চেঞ্জে আসে উইকেট। ৩৯তম ওভারে লিটন বল তুলে দেন ইবাদতের হাতে। ইবাদতের গতির তারতম্যে কাবু হন বাঁহাতি আকসার। কাভার দিয়ে উড়াতে গিয়ে পার করতে পারেননি। সাকিবের সহজ ম্যাচে পরিণত হওয়ার আগে ৫৬ বলে ৫৬ করে যান এই অলরাউন্ডার।

এরপর শার্দুল ঠাকুরকে স্টাম্পিং ফাঁদে ফেলেন সাকিব। ২০৭ রানে সাত উইকেট হারায় ভারত। এরপর মাঠে নামেন ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত। ২৮ বলে ৩টি চার ও ৫টি ছক্কায় ৫১ রানের ইনিংসে তাণ্ডব চালালেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি।

এর আগে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মিরাজের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে চ্যালেঞ্জিং পুঁজি পায় বাংলাদেশ। তাকে দারুণ সঙ্গ দেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। সপ্তম উইকেটে ভারতের বিপক্ষে নিজেদের রেকর্ড জুটি গড়ে তোলেন এ দুই ব্যাটার। ২০১৪ সালে এনামুল হক বিজয়ের সঙ্গে মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে গড়া ১৩৩ রানের জুটিকে পেছনে ফেলে রিয়াদ-মিরাজ এদিন গড়েন ১৪৮ রানের জুটি।

এরপর অষ্টম উইকেটে নাসুম আহমেদকে নিয়ে ৫৪ রানের আরও একটি দারুণ জুটি গড়েন মিরাজ। তাও মাত্র ২৩ বলে। তাদের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে শেষ পাঁচ ওভারে ৬৮ রান আসে বাংলাদেশের ইনিংসে। তাতে লড়াইয়ের পুঁজিটা বড় হয় টাইগারদের।

অথচ মাত্র ৬৯ রানেই বাংলাদেশ হারিয়েছিল প্রথম সারির ছয় উইকেট। তখন মনে হয়েছিল একশ রানের আগেই গুটিয়ে যাবে বাংলাদেশের ইনিংস। পরিসংখ্যান খুঁজে দেখা হচ্ছিল ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন রান কতো। রীতিমতো খাঁদের কিনারা থেকে দলকে টেনে তোলেন মিরাজ ও মাহমুদউল্লাহ।

ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির তুলে ঠিক ১০০ রান তুলে অপরাজিত থেকেছেন মিরাজ। ৮৩ বলে ৮টি চার ও ৪টি ছক্কায় নিজের ইনিংস সাজান এ অলরাউন্ডার। ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিয়ে মাহমুদউল্লাহ খেলেন ৭৭ রানের ইনিংস। শেষ দিকে ১১ বলে ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ১৮ রানের কার্যকরী ইনিংস খেলেন নাসুম আহমেদ।

এদিন নাজমুল হোসেন শান্তর বদলে ইনিংস ওপেন করতে নেমে দুই চারে শুরু করলেও ফের ব্যর্থ এনামুল। স্লিপে তার সহজ ক্যাচ রোহিত শর্মা ছাড়লেও ঠিক পরের বলেই ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ হয়ে যান তিনি। আউটের সঙ্গে রিভিউও নষ্ট করে যান এই ওপেনার।

হতাশ করেছেন অধিনায়ক লিটন দাসও (৭)। সিরাজের বলে লাইনেই যেতে পারেননি। রক্ষণাত্মক ঢঙ্গে খেলতে গিয়েও বোল্ড হয়ে যান। শান্ত (২১) পরাস্ত হন উমরান মালিকের গতিতে। বাড়তি বাউন্সের বলে অফস্টাম্প উড়ে যায় তার।

এরপর ওয়াশিংটন সুন্দরের বলে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে আকাশে তুলে আউট হন সাকিব (৭)। পরের ওভারে ফিরে জোড়া ধাক্কা দেন এ স্পিনার। শেষ দুই বলে আউট করেন মুশফিকুর রহিম ও আফিফ হোসেনকে। লেগ স্লিপে দাঁড়ানো শেখর ধাওয়ানে হাতে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন মুশফিক। আফিফ হোসেন বোল্ড হয়ে যান আর্ম বল বুঝতে না পেরে। তাতেই বড় চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ।

 

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

6h ago