ভয়ঙ্করতম সাড়ে ১৬ ঘণ্টা

‘গভীর সমুদ্র, অমাবস্যার গভীর রাত। উত্তাল সমুদ্রে তখন নাকি চলছিল ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত। এক জাহাজ থেকে উঠতে হবে আরেকটি জাহাজে। অথচ, জাহাজ ২টি উত্তাল সমুদ্রে পাশাপাশি দাঁড়াতেই পারছে না, হেলে যাচ্ছে ৩৫ থেকে ৪৫ ডিগ্রিতে। সন্তানদের নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমরা।’

'গভীর সমুদ্র, অমাবস্যার গভীর রাত। উত্তাল সমুদ্রে তখন নাকি চলছিল ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত। এক জাহাজ থেকে উঠতে হবে আরেকটি জাহাজে। অথচ, জাহাজ ২টি উত্তাল সমুদ্রে পাশাপাশি দাঁড়াতেই পারছে না, হেলে যাচ্ছে ৩৫ থেকে ৪৫ ডিগ্রিতে। সন্তানদের নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমরা।'

কথাগুলো বলছিলেন শাহিনুর আক্তার শাহীন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুবাদে সন্তানদের নিয়ে সপরিবারে তিনি বেড়াতে গিয়েছিলেন কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনে। আনন্দ উদযাপনের জন্য নির্বাচিত দিনগুলোর একটি তাদের জীবনে নিয়ে আসে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।

কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন এবং সেখান থেকে আবার কক্সবাজার ফিরতে অন্যদের মতো শাহিনুর আক্তারও টিকিট কেটেছিলেন কর্ণফুলী জাহাজের। ছিলেন প্রকৃতির মাঝে সুন্দর কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে সারা বছরের কর্মক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার অপেক্ষায়।

সেই উদ্দীপনায় প্রথম ধাক্কা আসে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য ধার্য তারিখের আগের রাতে।

দ্য ডেইলি স্টারকে শাহিনুর আক্তার বলেন, 'আমরা ৫০ জনের একটি গ্রুপ ভ্রমণে গিয়েছিলাম একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে। কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার আগের দিন রাত ১২টায় আমাদের কাছে মেসেজ আসে, কর্ণফুলী জাহাজটি নষ্ট, বে-১ জাহাজে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে সেন্টমার্টিন। বে-১ অনেক বড় হওয়ায় সেটি কক্সবাজার জেটি পর্যন্ত আসে না। তাই আমাদেরকে কক্সবাজার জেটি থেকে একটি জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হবে গভীর সমুদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা বে-১ এ।'

তিনি জানান, সকাল ৭টায় কক্সবাজার থেকে জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সময় মেনে কিছুই হয়নি। কক্সবাজার জেটি থেকে প্রায় ১ ঘণ্টার দূরত্বে গভীর সমুদ্রে দাঁড়িয়ে ছিল বে-১। জাহাজটি সেন্টমার্টিনের জেটিতেও ভিড়তে পারেনি। জেটি থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে একটি বার্জযোগে যাত্রীদের নিয়ে গেছে সেন্টমার্টিন জেটিতে।

শাহিনুর আক্তার বলেন, 'এত মানুষের ভিড়ে বারবার জাহাজ বদল করা, তাও আবার সমুদ্রের মাঝখানে, সে যে কি অবর্ণনীয় কষ্ট, তা বলে বোঝানো সম্ভব না।'

'জাহাজের কর্মীরা ওঠা-নামার জন্য কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি'- এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, 'জাহাজ কাত হয়ে যাচ্ছে, দুলছে। সঙ্গে ব্যাগ আছে, বাচ্চা আছে। সমুদ্রের মাঝে এভাবে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে ওঠা যে কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, সেটা যারা সেখানে আমরা ছিলাম তারাই কেবল অনুভব করতে পেরেছি। আমাদের সেন্টমার্টিনে পৌঁছানোর কথা ছিল ২টায়, কিন্তু পৌঁছাতে প্রায় ৩টা বেজে যায়।'

শাহিনুর আক্তার যে পরিস্থিতিকে ভয়ঙ্কর বলছিলেন তারচেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি যে তাদের সামনে অপেক্ষা করছে, তা তখনো তিনি জানেন না।

সেই সময়ের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, 'গত মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় সেন্টমার্টিন থেকে আমাদের নিয়ে জাহাজ ছেড়ে আসার কথা। কক্সবাজার থেকে যাওয়ার মতোই প্রথমে একটি বার্জ সেন্টমার্টিন জেটি থেকে আমাদের নেবে সমুদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা বে-১ এ, এরপর কক্সবাজারের কাছাকাছি এসে বারো আউলিয়া নামে জাহাজে উঠতে হবে, যেটি আমাদের নিয়ে যাবে কক্সবাজার জেটিতে। এটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা।'

কিন্তু 'ফেরার পথে জাহাজ কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা আরও বেশি ছিল' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'একটি গ্রুপ সেন্টমার্টিন জেটি থেকে ছেড়ে আসা বার্জ থেকে জাহাজে উঠবে এবং আরেকটা গ্রুপ জাহাজ থেকে বার্জে নামবে। বার্জে ওঠা-নামার এই কষ্ট এড়াতে আমাদেরকে ছোট ট্রলারে উঠিয়ে দেওয়া হলো। ট্রলারগুলোর সঙ্গেও জাহাজ কর্তৃপক্ষের চুক্তি থাকে। ওই ছোট ট্রলার থেকে জাহাজের এক কর্মী আমাদেরকে টেনে জাহাজে উঠিয়ে নেয়।'

ট্রলারের এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রাটা তাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়েছিল আরও কিছু মানুষের কাছে। সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে শাহিনুর আক্তার বলেন, 'আমাদেরকে তুলে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর ট্রলার থেকে যাত্রী তুলে নেওয়া বন্ধ করে দিলো, দরজা বন্ধ করে দিলো। সেই সময়ে সেখানে ৭-৮টা ট্রলারে যাত্রী এসে জাহাজের পাশে অপেক্ষায় ছিল। আমরা যারা উঠে গেছি, তারা জাহাজের কর্মীদের অনুরোধ করলাম এই ট্রলারের যাত্রীদের তুলে নিতে। কিন্তু তারা আমাদের অনুরোধ শোনেনি। ৭-৮টা ট্রলারে সাগরের মাঝে এতোগুলো মানুষ তাদের ছোট ছোট সন্তানসহ প্রায় ১ ঘণ্টা ভেসেছে। কিন্তু জাহাজের কর্মীদের তাতে কোনো নজর নেই। সেন্টমার্টিন জেটি থেকে দুপুর ৩টায় বার্জটি ছেড়ে বে-১ এর কাছে আসার পর জাহাজের কর্মীরা এই ট্রলারের যাত্রীদের তুলে নেয়। তারা আগে ট্রলার থেকে বার্জে উঠেছে, তারপর বার্জ থেকে জাহাজে উঠেছে।'

সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজার আসার পথে সময় যত গড়াচ্ছিল ততই তা বিপৎসংকুল হয়ে উঠছিল। শাহিনুর আক্তার জানান, দুপুর ২টায় সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজারের অভিমুখে রওনা হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা বে-১ যোগে কক্সবাজারের দিকে রওনা দেন বিকাল ৫টায়।

শাহিনুর আক্তার বলেন, 'গভীর সাগরে বে-১ থেকে আমাদেরকে আবার বারো আউলিয়া নামে জাহাজে উঠতে হয়েছে। রাত ৯টায় আমাদের থাকার কথা কক্সবাজার জেটিতে, সেখানে রাত সাড়ে ৯টায় গভীর সাগরে পৌঁছাই, যেখানে থেকে বারো আউলিয়ায় উঠব।'

তিনি বলেন, 'গভীর সমুদ্র, অমাবস্যার গভীর রাত। উত্তাল সমুদ্রে তখন নাকি চলছিল ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত। এক জাহাজ থেকে উঠতে হবে আরেকটি জাহাজে। অথচ, জাহাজ ২টি উত্তাল সমুদ্রে পাশাপাশি দাঁড়াতেই পারছে না, হেলে যাচ্ছে ৩৫ থেকে ৪৫ ডিগ্রিতে। সন্তানদের নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমরা।'

'আমাদের বড় জাহাজটিই, অর্থাৎ বে-১ জাহাজটিই তখন প্রচণ্ড ভাবে দুলছিল। পাশের ছোট জাহাজটির অবস্থা কল্পনা করে নিতে পারেন কি হচ্ছিল। বে-১ থেকে বারো আউলিয়ায় যাওয়ার ব্যবস্থা করতে জাহাজের কর্মীরা প্রায় ১ ঘণ্টা চেষ্টা করেও সিঁড়ি লাগাতে পারেনি। জাহাজ এত দুলছে যে তারা ওই সিঁড়িটা কোনোভাবেই ২ জাহাজের মাঝে আটকাতে পারেনি। অথচ তাদের এর জন্য ৫ মিনিটের বেশি সময় লাগে না।'

'জাহাজ কর্তৃপক্ষ কোনো কিছুই আমাদের জানাচ্ছিল না। বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকমের কথা বলছিলেন, ফলে অনেকের মধ্যে আতঙ্কও ছড়িয়ে পরে। প্রায় ৩ ঘণ্টা চেষ্টার পরও যখন ২ জাহাজের মধ্যে সিঁড়ি লাগাতে পারলো না, তখন জাহাজ ঘুড়িয়ে বিপরীত দিক দিয়ে চেষ্টা করলো। লোকমুখে শুনতে পাই, যে মোটা রশি দিয়ে ২ জাহাজকে বেঁধে দেওয়া হচ্ছিল, সেগুলো বাধার পরে জাহাজের প্রচণ্ড দুলুনিতে ছিঁড়ে যাচ্ছিল।'

জাহাজে এই পরিস্থিতি যখন, তখন রাত বাড়ছে, শত শত মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে। আতঙ্কিত মানুষগুলো কেবলই পরিত্রাণের অপেক্ষায়।

শাহিনুর আক্তার বলেন, 'কোনোভাবেই সিঁড়ি লাগাতে না পেরে এক পর্যায়ে তারা কাঠের পাটাতন বসিয়ে কিছু মানুষকে পাড় করতে থাকে। এটা একটা ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ জাহাজ তখন যেভাবে দুলছিল, তাতে যেকোনো সময় কাঠের পাটাতন দিয়ে পার হওয়া মানুষ দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। কিছু মানুষ বে-১ থেকে বারো আউলিয়ায় উঠে যাওয়ার পর আমরা শুনতে পেলাম, ওই পাটাতনটা ভেঙে গেছে। তবে, কারো কোনো ক্ষতি হয়নি।'

'এক পর্যায়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন জানান, এখানে যদি যাত্রীদের নামানো না যায়, তাহলে জাহাজটি চলে যাবে চট্টগ্রাম বন্দরে। তার আগে তারা একটি শেষ চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা আরও ভয়ঙ্কর।'

'বে-১ এর একটি ফ্লোর থেকে কাঠের একটি পাটাতন নামিয়ে দেওয়া হয় বারো আউলিয়ায়। সব ব্যাগ ছুড়ে দেওয়া হয় বারো আউলিয়ার দিকে। এরপর ওই পাটাতন দিয়ে বে-১ থেকে বারো আউলিয়ায় নেমে আসি আমরা। ওই গভীর রাতে এতগুলো মানুষের জন্য খাবারও একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে, সমুদ্রে জাহাজের দুলুনিতে ক্লান্ত ও ভীত হওয়ার পাশাপাশি প্রতিটা মানুষই তখন প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। জাহাজ কর্তৃপক্ষ প্রথম দিকে গড়িমসি করলেও পরে খিচুড়ি রান্না করে সবাইকে দিয়েছে।'

বারো আউলিয়ায় উঠেই তারা এই ভয়ঙ্কর যাত্রা থেকে পরিত্রাণ পাননি।

'বে-১ থেকে সব যাত্রী বারো আউলিয়ায় তুলতে প্রায় ভোররাত ৩টা বেজে যায়। অর্থাৎ মাড়ে ৬ ঘণ্টা আমরা সেখানেই। ছোট ২টা জাহাজে আমাদের কক্সবাজার জেটিতে যাওয়ার কথা থাকলেও ১টাতেই সবাইকে তারা তুলে নিলো। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আরেকটি বিপদজনক সিদ্ধান্ত ছিল।'

'বারো আউলিয়া যখন কক্সবাজার জেটির দিকে যাত্রা শুরু করবে, তখন শুরু হয় ভাটা। শেষ পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৬টায় আমরা পৌঁছাই কক্সবাজার জেটিতে। সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজারে যেতে ৭ ঘণ্টার যাত্রা আমাদের শেষ হয় সাড়ে ১৬ ঘণ্টায়। আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সাড়ে ১৬ ঘণ্টা।'

'ওই সময়টা পুরো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কেবলই মনে হচ্ছিল, আজই জীবনের শেষ দিন। যদি ওই মুহূর্তের অভিজ্ঞা বলতে হয়, তাহলে সেটা আমার পক্ষে সম্ভব না। এতটা ভয়াবহতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো শব্দ আমার জানা নেই।'

Comments

The Daily Star  | English

Iran's President Raisi, foreign minister killed in helicopter crash

President Raisi, the foreign minister and all the passengers in the helicopter were killed in the crash, senior Iranian official told Reuters

3h ago