‘ছেলেকে জ্ঞানের আলো নিতে পাঠালাম, চোখের আলো হারিয়ে এল’

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) ছাত্রলীগের ২ পক্ষের সংঘর্ষে ডান চোখ হারাতে বসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ফিসারিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ওমর ফারুক।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মো. ওমর ফারুক। ছবি: স্টার

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) ছাত্রলীগের ২ পক্ষের সংঘর্ষে ডান চোখ হারাতে বসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ফিসারিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ওমর ফারুক।

সংঘর্ষের সময় ইটের একটি টুকরা ডান চোখে লাগলে আহত হন ফারুক। বর্তমানে তিনি রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আজ রোববার হাসপাতালে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয় ফারুকের সঙ্গে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, 'গত শুক্রবার ঘটনার দিন আমাকে বলা হয়, হলের নিচে থাকতে হবে। সেখানে ছাত্রলীগের ২ পক্ষ পরস্পরের দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারছিল। এক পাশে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী হল, অপর দিকে শাহ এ. এম. এস. কিবরিয়া হল। ২ পাশ থেকেই ঢিল ছুঁড়ছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।'

'এ সময় আমার ২ বন্ধু ও ১ বড় ভাই আহত হলে তাদের ৩ জনকে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে পাঠাই। তারপর আমি দাঁড়াই আব্দুস সামাদ আজাদ হলের গেটের সামনে। সেখানে দাঁড়ানো অবস্থাতেই কারো ছুঁড়ে মারা একটি বড় ইটের টুকরো এসে আমার ডান চোখে লাগে। তখন সময় বিকাল প্রায় ৪টার মতো।'

'ঢিল লাগার পর আমার চোখে থাকা চশমাটি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, চোখ কেটে প্রচুর রক্ত বের হতে থাকে। এরপর আমার এক বন্ধু তার মোটরসাইকেলে করে আমাকে হেলথ কেয়ারে নিয়ে যায়, সেখান থেকে পাঠানো হয় সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আমরা ঢাকায় আসি।'

সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থলে কেন গিয়েছিলেন জানতে চাইলে ফারুক বলেন, 'হলে থাকতে হলে নেতারা যা বলবেন তা আমাদের শুনতেই হয়। যারাই হলে আছেন, তারা কোনো পদধারী নেতার সঙ্গে নেই, এমনটি হয় না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথমে ছিলাম হযরত শাহ পরান (র.) হলে। সেখান থেকে রাজনৈতিক কারণে আমাকে সরিয়ে নেওয়া হয় আব্দুস সামাদ হলে।'

ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের মো. আলমগীর হোসেন ও মেরিনা আক্তার দম্পতির ২ ছেলের মধ্যে বড় ফারুক।

ফারুকের বাবা মো. আলমগীর হোসেন। ছবি: স্টার

ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে মো. আলমগীর হোসেন বলেন, 'শনিবার ভোররাত ২টা ৪০ মিনিটে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ায় আমাদের অ্যাম্বুলেন্স। ইমার্জেন্সির ডাক্তার ফারুককে নিয়ে যান তার চোখ ওয়াশ করতে। পরে আমাদেরকে ডেকে বলেন, ফারুকের চোখের যে পরিস্থিতি তাতে এই চোখে সে হয়তো আর দেখতে পাবে না। পরবর্তীতে মেডিকেল বোর্ড বসেছে। বোর্ডও জানিয়ে দিয়েছে, এই চোখটা হয়তো আর ভালো হবে না।'

একই কথা জানিয়ে ফারুকের মা মেরিনা আক্তার বলেন, 'আমরা ফারুককে দেশের বাইরে নেওয়ার কথাও বলেছি। কিন্তু, ডাক্তাররা বলেছে, বাইরেও এর চিকিৎসা নেই। যদি কেউ চোখ দান করে তাহলেই কেবল ডান চোখটায় দেখতে পারবে।'

 

আমার সুস্থ সবল ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালাম জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে। আর আমার সেই ছেলে তার চোখের আলো হারিয়ে আমার কাছে এল। এই কষ্ট কোথায় রাখব?

মো. আলমগীর হোসেন, ওমর ফারুকের বাবা

তিনি আরও বলেন, 'ডাক্তাররা একইসঙ্গে এটাও বলেছেন, এভাবে কারো চোখ নেওয়া সম্ভব না। কারণ, কোনো সুস্থ মানুষের চোখ তারা নেবেন না, মুমূর্ষু রোগীর চোখ নিতে পারবেন। আমি বলেছি, আমি আমার চোখ দেবো। তাও আমার ছেলের ভবিষ্যৎ যেন অন্ধকার না হয়ে যায়। আমার ছেলে যেন আমার চোখে আমাকে দেখে। আপনারা এর ব্যবস্থা করেন। আমার চাওয়া একটাই, আমার ছেলের চোখ যেন ঠিক হয়ে যায়।'

আলমগীর হোসেন শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারেন না। ত্রিশালে নিজের জমিতে কয়েকটি ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন তারা। সেই যৎসামান্য আয়েই চলে তাদের সংসার। ফারুক টিউশনি করে নিজের পড়াশুনার খরচ চালান।

উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেক বেশি খরচ করতে হলে সেই সামর্থ্য নেই জানিয়ে আলমগীর হোসেন বলেন, 'আমার সুস্থ সবল ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালাম জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে। আর আমার সেই ছেলে তার চোখের আলো হারিয়ে আমার কাছে এলো। এই কষ্ট কোথায় রাখব?'

মেরিনা আক্তার বলেন, 'ছেলের ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়েছি। আজ ওর যে অবস্থা, তাতে ভবিষ্যৎ সুন্দর হওয়ার বদলে আরও অন্ধকারের পথে চলে যাচ্ছে। ছেলের ভবিষ্যৎ সুন্দর করার যে প্রত্যাশায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছি, সেটা যেন হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এটাই আমার চাওয়া।'

ফারুকের মা মেরিনা আক্তার। ছবি: স্টার

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানান এই দম্পতি।

সিকৃবির ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মাহফুজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অপারেশনের পর ডাক্তার আমাদেরকে জানিয়েছেন, তার চোখের আলো ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে সম্ভাবনা একেবারেই নেই, সেটা বলছি না। ডাক্তাররা তাদের সর্বোচ্চটা করছেন। ফারুকের উন্নত চিকিৎসায় কিছু করার থাকলে তা করতে বিশ্ববিদ্যালয় তৎপর আছে।'

ফারুকের চিকিৎসার ব্যয় ও ক্ষতিপূরণের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কী উদ্যোগ নিচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নেব। তারপর এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারবো।'

আমি আমার চোখ দেবো। তাও আমার ছেলের ভবিষ্যৎ যেন অন্ধকার না হয়ে যায়। আমার ছেলে যেন আমার চোখে আমাকে দেখে। আপনারা এর ব্যবস্থা করেন। আমার চাওয়া একটাই, আমার ছেলের চোখ যেন ঠিক হয়ে যায়।

মেরিনা আক্তার, ওমর ফারুকের মা

সিকৃবি ছাত্রলীগের সভাপতি আশিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। সে ছাত্রলীগের কোনো কমিটিতে না থাকলেও আমাদেরই ছোট ভাই। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য আমরা অবশ্যই তার পাশে থাকবো।'

ছাত্রলীগের ২ পক্ষের সংঘর্ষে একজন সাধারণ শিক্ষার্থীকে চোখ হারাতে হচ্ছে, এর দায় ছাত্রলীগ এড়াতে পারে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'অবশ্যই আমাদের কষ্ট লাগছে। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই আমরা তার পাশে আছি।'

ফারুকের অবস্থা সম্পর্কে জানতে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয় মেডিকেল বোর্ডের সভাপতি ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্নিয়া বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল্লাহর সঙ্গে।

তিনি বলেন, 'ফারুকের ডান চোখের কর্নিয়াতে খুব খারাপভাবে একটি ইনজুরি হয়েছে। আঘাতে ওনার চোখের মনিটা ফেটে গেছে। শুধুমাত্র চোখে আলো ফেললে তা বুঝতে পারছেন। এ ছাড়া, তিনি কিছু দেখতে পারছেন না। অর্থাৎ, কোনো কিছুর অবয়ব দেখা, আঙুল গোনার মতো অবস্থা নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা আমাদের প্রাথমিক সব কাজ সম্পন্ন করেছি, তার চোখের ইনজুরি রিপেয়ার করে দিয়েছি। এখন পরবর্তীতে অপেক্ষা করছি কতটা উন্নতি হয় তা দেখার জন্য। তার দেখার সক্ষমতা কতটা ফিরবে তা আরও কিছুটা সময় না গেলে বোঝা যাবে না। তবে, এত খারাপভাবে আঘাত পেয়েছে যে আমরা তার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে খুব বেশি আশাবাদী না।'

দেশের বাইরে এর উন্নত চিকিৎসা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করালে কোনো ভালো ফলাফল আসবে কি না, সেটা বলার মতো পর্যায়ে এখনো আসেনি। এটা আরও পরে হয়তো বলা যাবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Love road at Mirpur: A youthful street

Certain neighbourhoods in Dhaka have that one spot where people gather to just sit back and relax. For Mirpur, it’s the frequently discussed street referred to as “Love Road”.

4h ago