ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের তথ্য শিক্ষার্থীদের সংকটে ফেলবে
গত কয়েকদিন যাবৎ অনেক আলোচনা-সমালোচনার কারণে নানা ব্যস্ততার মাঝেও ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই পড়ার সুযোগ করে নিলাম। আমার স্ত্রীও যেহেতু এই বিষয়ের শিক্ষক, তাই তার সঙ্গে আলাপ ও এ বিষয়ে কী ধরনের প্রশিক্ষণ হয়েছে তাও জানার সুযোগ হলো এ কয়দিনে।
ষষ্ঠ শ্রেণির অনুশীলনী বইয়ের কয়েকপাতা উল্টানোর পরে ১৬ থেকে ২২ পৃষ্ঠায় ভালুকের গল্প শুনিয়ে ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া বেশ বেখাপ্পা মনে হলো। কিছু দুর্বোধ্য ও বিদেশি শব্দ, যেগুলোর সাবলীল বাংলা করা সম্ভব, সেসব বিষয়েরও ইংরেজি শব্দ, বাংলা দুর্বোধ্য শব্দ ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কঠিন হবে বলে মনে হলো।
শিক্ষার্থীদের নাম হিসেবে যেসব শব্দ নিয়ে আসা হয়েছে, তাতেও এক ধরনের গা ছাড়া ভাব পরিলক্ষিত হয়। 'ফ্রান্সিস' কিংবা 'অনুসন্ধান' দেশের কোনো শিক্ষার্থীর নাম হিসেবে এ বয়সের শিক্ষার্থীরা পরিচিত নয়। আমরাও নই। কিছুদূর গিয়ে মনে হয়েছে, শিক্ষার্থীদের জোর করে হলেও গবেষণা শেখানোর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যেখানে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই গবেষণার সঙ্গে পরিচিত কিংবা গভীরভাবে সম্পর্কিত নন, এমনকি স্কুল কলেজের শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও গবেষণা প্রবন্ধ বাধ্যতামূলক নয়, সেখানে হঠাৎ করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের কায়দা করে এমন গবেষণায় সংযুক্ত করার ব্যাকুল বাসনা হলেও তা বাস্তবরূপ লাভ করবে কি না, তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।
প্রতিটি অধ্যায়ে খুশি আপাকে দিয়ে জোর করে গল্প বানিয়ে সেটাকে শিক্ষার্থীদের খাওয়ানোর প্রচেষ্টা বইটিতে লক্ষণীয়। এই পাঠ্যবইয়ে সমাজ বিজ্ঞানের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক অনেকটাই খাপছাড়া। আবার ইতিহাসের গল্পকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের দীর্ঘসময় স্মরণে রাখা অসম্ভব হবে।
প্রাগ-ইতিহাস পরবর্তী আদি ঐতিহাসিক এর ঐতিহাসিক ঘটনা, প্রত্নস্থান, ষোড়শ মহাজনপদ, মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানি, মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ— এই যে ইতিহাসের কালানুক্রম, সেটাকে ঘোরাতে-পেছাতে গিয়ে এত বেশি জটিল করা হয়েছে যে, কোর্স শিক্ষকই হিমশিম খাবেন।
একটি অধ্যায়ের সঙ্গে আরেকটি অধ্যায়ের সংযুক্তিতে কোনো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি, যা শিক্ষার্থী ও শিক্ষক— উভয়ের জন্যই বোঝা হবে। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে দলগতভাবে কাজ দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে যেসব শিক্ষার্থী দুর্বল, তাদেরকে শনাক্ত করে নিবিড় সহযোগিতা করা শিক্ষকের জন্য কঠিন হবে। এই পাঠ্য পড়াতে গেলে নানা উপায়ে উপস্থাপনার যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সে ধরনের উপকরণ, পরিবেশ, সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি। যে কারণে দেখা যাবে অধিকাংশ অধ্যায়ের বাস্তবায়নের বদলে তা শুধু মুখে আওড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
বেশ কিছু অধ্যায়ে অভিভাবক, প্রতিবেশী এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কাজ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের চিরায়ত বাস্তবতায় এখনো কিশোররা এ ধরনের কাজ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে না। সেই সঙ্গে অভিভাবকরাও সে ধরনের মানসিক, শিক্ষাগত কিংবা সাংস্কৃতিক দিক বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবে না। যেমন: সক্রিয় নাগরিক ক্লাব, বইপড়া ক্লাব, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ক্লাব— এগুলো পড়তে বেশ চটকদার, মজার, গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলেও এ বিষয়ে যে বাস্তবিক কাজ দেওয়া হয়েছে, শিক্ষার্থীরা সময়, পরিবেশ ও বাস্তবতার নিরিখে অধিকাংশই যে তা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। একাধিক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেও তা নিশ্চিত হয়েছি।
ষষ্ঠ শ্রেণির অনুশীলনী বইয়ের ৬৮ নম্বর পৃষ্ঠায় 'আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা' গল্পে শিক্ষার্থীদের যে কাজ দেওয়া হয়েছে, অধিকাংশ স্কুল ও সেখানের শিক্ষার্থীরাই তা করতে পারবে না। ৮০ নম্বর পৃষ্ঠায় মুক্তির দাদির মুখ থেকে বলা ইতিহাস যেন জোর করেই মুখ থেকে বের করা হয়েছে, এটি আর এখানে গল্প হয়ে উঠেনি। ৮১ নম্বর পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের বিষয় জানার জন্য প্রশ্নমালা তৈরি করা হয়েছে, যা আসলে ভালো মনে হলেও শিক্ষার্থীরা এমন সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ও সুযোগ পাবে কি না, তা যথেষ্ট সন্দেহের দাবি রাখে।
৮৪ থেকে ৮৬ নম্বর পৃষ্ঠায় রুব্রিক্স পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী কর্তৃক দলের সদস্যদের পারফরম্যান্স মূল্যায়নের কথা ও তালিকা দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই অনেক শিক্ষক অনুসরণ করতে পারছে না। এমন বিষয়গুলো ষষ্ঠ শ্রেণিতে নিয়ে এসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য যে তা ভোগান্তি বয়ে আনবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিবর্তনের যে আলাপ ষষ্ঠ শ্রেণিতে নিয়ে আসা হয়েছে, তাও এ বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে জানানো জরুরিও নয়, দরকারিও নয়। বরং পুরো বইজুড়ে মনে হয়েছে পাঠ্যবইটি প্রস্তুত করার সময়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক বিষয়টি লেখকরা বিবেচনায় নেননি। বরং তারা কী ধরনের চিন্তার মানুষকে আগামীতে দেখতে চান, সেই মনের ভাবনাই পাঠ্যবইয়ে হাজির করেছেন।
কখনো কখনো মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামনে রেখে তার গুণগান গাওয়ার আড়ালে ইচ্ছেমতো ইতিহাসের গল্প সাজানো হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের গল্পের চেয়ে ভিনদেশি ইতিহাস শিক্ষার্থীদের জানানো হচ্ছে। আমাদের ভূখণ্ডের ইতিহাস, প্রত্নস্থানের গল্প, এই ইতিহাস ঐতিহ্য অন্বেষণে যারা নিযুক্ত সেই ইতিহাস, ঐতিহাসিকদের পরিচিত না করিয়ে, ইতিহাসে শিক্ষার্থীদের জন্য যে প্রেরণামূলক গল্প আছে— যা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার মধ্যে ঐক্য তৈরি করবে, তার বদলে কখনো কখনো মনে হয়েছে খুব সুচতুরভাবে কিছু বিষয়কে বারবার শিক্ষার্থীদের জানানোর মধ্য দিয়ে একটা বিশৃঙ্খলার, বিদ্বেষের মগজ ধোলাইয়ের চেষ্টা আছে বইয়ে। মৌর্য থেকে এ পর্যন্ত বাংলায় ঐতিহাসিকভাবে কারা কারা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে, সেবার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক গড়েছে, আর কারা এদেশে বিভিন্ন সময়ে নানা ষড়যন্ত্র নিপীড়ন করেছে— সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে শত্রুদের চিত্রায়িত করা হয়নি, বন্ধুদেরও শনাক্ত করা হয়নি।
সপ্তম শ্রেণির বইয়ে এদেশের কোনো প্রত্নস্থানের, কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনার ছবি দেওয়া যেত। সেটি না করে পাটালিপুত্রের ধর্মীয় মন্দির স্থাপনার ছবি তা কোনোভাবেই বইয়ের প্রচ্ছদের সঙ্গে যায় না। উয়ারী-বটেশ্বর, মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়নামতি, ষাটগম্বুজ মসজিদ, কান্তজীর মন্দির, যা বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, এমন স্থান, ঐতিহাসিক স্থাপনাকেই প্রচ্ছদে স্থান দেওয়া যুক্তিযুক্ত হতো। প্রচ্ছদে পদ্মফুল, জবাফুল কিংবা ময়ূরের চেয়ে দেশের জাতীয় প্রতীকগুলো দেওয়াই হতো বেশি যুক্তিযুক্ত। মলাটের ভেতরের ইন্দিরা গান্ধীর বৃহদাকৃতির ছবিও অনেকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়। অনুসন্ধানী বইটি দেখে কিংবা পড়ে মনে হতে পারে এটি ভারতের ইতিহাস পড়ছি। ভারতের অন্য কোনো ভূ-খণ্ডের ন্যায় না হয়ে এটি কেন মুসলমান-প্রধান দেশ হিসেবে গড়ে উঠল, সে বিষয়ে বিস্তর আলাপ নেই বইটিতে। অনুসন্ধানী বইয়ের মানচিত্রেও বাংলাদেশের কোনো মানচিত্র নেই, যা যে কাউকে মনোক্ষুণ্ন করবে।
ভাষা, ধর্ম ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাঝে যে সম্পর্ক রয়েছে, তা সঠিকভাবে তুলে আনার প্রচেষ্টা থাকলে বাংলাদেশের মানুষের বহুমাত্রিকতা ও প্রাচীন বাংলা ভাষার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী নৃগোষ্ঠীদের ভাষার সম্পর্ক নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হতো। সে বিষয়ে কোনো চেষ্টা করা হয়নি। বইটি কীসের ইতিহাস বা কোন ভূখণ্ডের, কোন সময়কার কথা বলছে, বিষয়সূচিতে তার উল্লেখ নেই।
অনুসন্ধানী বইটি হঠাৎ শেষ হলো সুলতানি আমলের বিচ্ছিন্ন আলাপের মধ্য দিয়ে। পুরো বিষয়টিই সন্দেহের উদ্রেক করে যে, আসলে ধর্মের বিবর্তন ও মিশ্রণকে অস্বীকার করে সংস্কৃত ভাষাকে আদি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা যে বিভিন্ন এলাকার জনগোষ্ঠী ও ব্যবসা-গোষ্ঠীর মাঝে রয়েছে, তারই যেন প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে এখানে। দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে বাংলা ও বাংলা-ভাষাভাষীদের নীচু, ম্লেচ্ছ, প্রান্তিক করার প্রচেষ্টা বহুদিনের। বর্তমান পাঠ্যবই এমন আশঙ্কাকে সামনে নিয়ে আসে।
আগামীর প্রজন্মকে বাংলা, বাংলার ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, নৃ-তত্ত্ব ও তার পার্শ্ববর্তী জনপদকে ইতিহাস পাঠের কেন্দ্রে রাখা দরকার। নতুন প্রজন্মের মননে, গঠনে আত্মপরিচয় নির্মাণে অহেতুক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একপেশে অবস্থান বাদ দিয়ে, সবার সঙ্গে ভাষার ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে, সংস্কৃতির বিবেচনায় কীভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিনির্মাণ করা যায়, সে দিকটি লক্ষ্য রাখা উচিত এ ধরনের পাঠ্যবইয়ে। যা অনুপস্থিত।
লেখক: শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments