রোম যখন পুড়ছিল, নিরো কি সত্যিই বাঁশি বাজাচ্ছিলেন

রোম যখন পুড়ছিল, নিরো কি সত্যিই বাঁশি বাজাচ্ছিলেন
এম দে লিপম্যানের আঁকা ‘নিরো অ্যান্ড দ্য বার্নিং অব রোম’। ছবি: কিউয়ি হেলেনিস্ট

রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সম্রাট নিরো, যিনি 'রোম ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সময় বাঁশি বাজানোর (নির্লিপ্ত অর্থে) জন্য কুখ্যাত'। বাংলায় 'রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন' প্রবাদটি যেই ইংরেজি প্রবাদের (Nero fiddles while Rome burns) অনুবাদ, সেখানে মূলত বাঁশি নয়, বেহালার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সত্যিই কি এটি ঘটেছিল? নিরোকে ইতিহাসে যতটা কুখ্যাত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তিনি কি আসলেই তেমন ছিলেন?

প্রতিটি গল্পের সত্যতা নিরুপণের জন্য এর মূল উৎসের দিকে নজর দেওয়া উচিত। 

নিরো জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর। তিনি ছিলেন রোমের পঞ্চম সেনাপতি এবং জুলিও-ক্লদিয়ান বংশের শেষ শাসক। এই জুলিও-ক্লদিয়ানই রোমান সমাজ্র্যের প্রতিষ্ঠাতা। 

নিরোর বয়স যখন মাত্র ২ বছর, তখন সম্রাট ক্যালিগুলা নিরোর মা অ্যাগ্রিপিন্নাকে নির্বাসে পাঠান। নিরোর মায়ের প্র-পিতামহ ছিলেন অগাস্টাস, যিনি ছিলেন এই এই সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা। ৩ বছর বয়সে নিরো তার বাবাকে হারান। এরপর তিনি তার খালার কাছে বড় হতে থাকেন। রাজা ক্লদিয়াস ৪১ খ্রিষ্টাব্দে ক্যালিগুলিকে খুন করে ক্ষমতা দখল করার পর নিরো আবারও অ্যাগ্রিপিন্নার সঙ্গে মিলিত হন, যিনি পরবর্তীতে ক্লদিয়াসকে বিয়ে করেন। 

নিজের ঔরসজাত সন্তান থাকা সত্বেও ক্লদিয়াস সৎ ছেলে নিরোকে তার উত্তরাধিকার নিযুক্ত করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ৫৪ খ্রিস্টাব্দে নিরো ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেন। কিন্তু তার রাজত্বকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। ৬৮ খ্রিস্টাব্দে, মাত্র ৩০ বছর বয়সে নিরো আত্নহত্যা করেন। 

রোমান ইতিহাসবিদদের ধারণা, নিরো অ্যাগ্রিপিন্না এবং তার আরও দুই স্ত্রীকে খুন করে। তিনি শুধু নিজের শিল্পকেই গুরুত্ব দিতেন। রাজত্বের দিকে তার কোনো খেয়ালই ছিল না। তবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার প্রফেসর এমিরিটাস হ্যারল্ড ড্রেক বলেন, 'নিরো সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যের উৎস যারা, তারা সবাই নিরোকে ঘৃণা করতো।' 

তিনি বলেন, 'নিরো সম্পর্কে নির্মোহ বিশ্লেষণ করতে চান, এমন সবারই মনে রাখা উচিত, তার ইতিহাস রচয়িতারা সবাই ছিল তার শত্রু।'

৬৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাইতে নিরো অ্যান্টিমে (যেটি এখন ইতালির অ্যানজিও শহর) ছুটি কাটানোর সময় রোমে আগুন লাগার কথা জানতে পারেন, যেটি পরবর্তীতে ইতিহাসে দ্য গ্রেট ফায়ার অব রোম নামে পরিচিতি পায়। এক সপ্তাহ পর যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, ততক্ষণে রোমের ১৪টি জেলার ১০টি পুরোপুরি ভষ্ম হয়ে যায় এবং শহরের ৫-১০ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। অনেকের ধারণা নিরো নিজেই এই আগুন লাগিয়েছেন। যাইহোক, সেটি অবশ্য অন্য আলাপ। 

নিরো জরুরিভিত্তিতে রোমে ফিরে গিয়ে বিপন্নদের জন্য আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেন। ড্রেক বলেন, এমনকি আশ্রয়প্রার্থী মানুষদের জন্য নিজের প্রাসাদ ও বাগান পর্যন্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন নিরো। 

নিরো যদি অগ্নিকাণ্ডের সময় রোমে না-ই থাকেন, তাহলে 'রোম যখন আগুনে পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন' এই গল্প কীভাবে এলো?

ড্রেক বলেন, 'নিজেকে গায়ক হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করতেন নিরো। রোমের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার মানুষদের জন্য সহায়তা কার্যক্রম চলার সময়ই এমন একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে।'

'অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থেকে রোমকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নিজের সাধ্যের মধ্যে সবটুকুই করেছেন নিরো এবং তিনি ছিলেন ক্লান্ত। নিজের শৈল্পিক ঝোঁক থেকেই তিনি এ অগ্নিকাণ্ডকে ট্রয়ের পতনের সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।'

ড্রেক বলেন, 'এমনকি নিরো যদি রোম পুড়ে যাওয়ার সময় কোনো সঙ্গীত বাজাতেনও, সেখানেও বেহালা থাকার সম্ভাবনা অনেক কম। কারণ বেহালার মতো বাদ্যযন্ত্র পরবর্তী ১ হাজার বছরেও জনপ্রিয়তা পায়নি। বস্তুত, নিরো হয়তো 'চিতারা' ব্যবহার করতেন, যেটি ছিল ৭টি তারযুক্ত এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র।'

ড্রেক বলেন, 'অগ্নিকাণ্ডের পর নিরো সর্বহারা মানুষদের নতুন করে গৃহনির্মাণের জন্য অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন, তাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন পানির সরবরাহ নিশ্চিত করেছিলেন। এগুলো কিন্তু পাগলাটে লোকের কাজ হতে পারে?'

তাহলে কেন ইতিহাস নিরোকে একজন খারাপ শাসক হিসেবে চিত্রায়িত করেছে? বর্তমানে সম্রাট নিরো সম্পর্কে যত তথ্য ও ঘটনা প্রচলিত আছে, তার প্রয় সবগুলোর উৎস মূলত দুটি: রোমান সিনেটর এবং খ্রিষ্টানরা। তারা উভয়ই ছিল নিরোর ঘোর শত্রু। 

সিনেটরার নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করতেন, যেগুলো নিরো শক্তহাতে প্রতিরোধ করেছেন। আর খ্রিষ্টানরা নিরোকে দেখতে পারতো না, তার কারণ একটা গুজব ছড়িয়েছিল যে নিরো নিজেই এই আগুন লাগিয়েছিল এবং এর দায় খ্রিষ্টানেদের ওপর চাপাতে চাইছিল। 

নিরো হয়তো অতটা খারাপ শাসক ছিলেন না, ইতিহাস তাকে যেভাবে বর্ণনা করে। তবে, তার শাসনমল ছিল অস্থিতিশীল। সে সময়কার অন্যান্য অত্যচারী শাসকদের মতো তিনি নিজেও অনেক অযৌক্তিক কাজ করেছেন। 

 

 

Comments

The Daily Star  | English

‘For 15 years I fought for BNP leaders and activists, today they pushed me’

Rumeen Farhana says she was almost knocked down during clash at EC over Brahmanbaria boundaries

33m ago